Home / রবিবারের আড্ডা / গল্প / রবিবারের ছোটগল্প কাকতালীয় লিখেছেন মোহাম্মদ জসিম

রবিবারের ছোটগল্প কাকতালীয় লিখেছেন মোহাম্মদ জসিম

ছোটগল্প

কাকতালীয়

মো হা ম্ম দ জ সি ম

ছোটগল্প

Illustration: Preety Deb


মাঝখানে কতদিন কেটে গেছে গোনাগুনতি নেই।তবু ঝুমুরকে চিনতে একটুও কষ্ট হয়নি তার। শাড়িতে ঝুমুরকে আগেও দেখেছে সে, আজ যেন বেশিই সুন্দর লাগছে। রাজন প্রায়-ই বলতো, শাড়ি পরলে তোমাকে পরির মতো লাগে। আজও পরির মতোই,তবে যেন একটু বিমর্ষ-বিষন্ন-বিষাদময়…। আজও ঝুমুর একা আসেনি। তার হাত ধরে হাঁটছে যে পুরুষটি, সে সম্ভবত তার স্বামী। যে-ই হোক, ঝুমুর কিংবা রাজন কেউ কোনদিন একা আসেনি এখানে। শীতের শুরুর দিকে, কেবল কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে কয়েকদিন হলো। এই কুয়াশামাখা সন্ধ্যার আবছা আলো আঁধারিতে এত দূর থেকেও ঝুমুরকে চিনতে পেরে কিছুটা আনন্দিত হয় আজীবন একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা একচোখা লাইটপোস্টটি। যেন বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়টি এইমাত্র ঘরে ফিরে এলো।এক্ষনি তাকে ঘিরে ভিড় জমে উঠবে প্রতিবেশীদের। লাইটপোস্টটি জানে, এরকম কিছুই ঘটবে না অন্তত…কতগুলো দিন! গোনাগুনতি নেই! অনেকদিন আগের কথা, হয়তো বা অনেক বছর আগের, গোনা-গুনতি জানে না বলে একটু যেন লজ্জা পেল বৃদ্ধ লাইটপোস্টটি। মূর্খ সে-মানুষদের মতো তাদের কোন বিদ্যালয় থাকে না। মা থাকে না এক দুই শেখানোর জন্য। লাইটপোস্টটি ভাবছে, স্মৃতির গলি-উপগলি হয়ে ভাবনার মহাসড়কে হেঁটে চলছে চূড়ান্ত নষ্টালজিক পথিক এক! প্রথমদিকে রাজন আর ঝুমুর একসাথে প্রতিদিন এখানে আসতো-বসে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা। গল্প করতো-মনুষের উৎসুক চোখ এড়িয়ে চোরাগুপ্তা চুমুতে নামিয়ে আনতো ভবিষ্যতের মেরুন বারান্দার উষ্ণ-সন্ধ্যার আবহ, কি সুন্দর আর স্বর্গীয় সেইসব দৃশ্যের মায়ামুখ! তিন চার বছর হবে। ঝুমুর ও রাজন। রাজন ও ঝুমুর। একা নয়-একসাথে, যুগলবন্দী। তারপর কি হলো কে জানে! না রাজন না ঝুমুর কারো দেখা মেলেনি বেশ কিছুদিন। সেইসব দিনে এই একলা লাইটপোস্টটি নিরুচ্চারে আলো দিতে দিতে শুধুই ভেবেছে। লাইটপোস্টদের জীবন যেমন হয়, কোনো পরিবর্তন নেই, শুধু্ই নির্বিকার আলো বিলিয়ে যাওয়া, নিয়মমাফিক ঘড়ি ধরে। প্রতিদিন। কিন্তু মানুষের জীবন এমন নয়। সময়ের প্রয়োজনে বদলায়, বদলাতে হয়। লাইটপোস্ট তা জানতো না। রাজনকে দেখা গিয়েছিলো তার অনেকদিন বাদে। একা নয় অবশ্যই। সাথে তার নতুন মেয়েমানুষ। সেদিন এই বৃদ্ধপ্রায় একচোখা লাইটপোস্টের বুকের ভেতরটা হঠাৎই ছ্যাৎ করে ওঠে। লাইটপোস্ট আর মানুষের জীবনের মাঝে যে বিস্তর ফারাক তা তার জানার কথা নয়। তাই হয়তো সে ভেবেই বসেছিলো, ঝুমুর মারা গেছে। মৃত ঝুমুরের জন্য সে কেঁদেছে অনেক। এই রৌদ্রোজ্জ্বল পৃথিবীতে ঝুমুরের যেন ওই একটাই অবিভাবক ছিল। সেইসব কান্নার কালও কেটে যেতে বেশি দিন লাগেনি। রাজন আর তার নতুন প্রেমিকাকে দেখে দেখে চোখ সওয়া হয়ে গেছিল। এই মেয়েটির নাম, পলা। পলা অনিন্দ্য সুন্দরী। হাল ফ্যাশানের কোর্তা-কামিজে রাজন তাকে যতই পরির মতো দেখুক, লাইটপোস্টটি পলাকে কখনোই ঝুমুরের সমকক্ষ ভাবতে পারেনি। ঝুমুর তার কাছে অবচেতনেই আত্মজা হয়ে জেগে থাকে সারাক্ষণ। বিস্ময়ের বাকি ছিল আরো। এক সোমবার বিকেল, বিলগ্ন পার্কের সেই বেঞ্চিতে সেই লাইটপোস্টের নিচে এসে বসেছিলো ঝুমুর। সেটি ছিল সেবছরের সবচেয়ে মেঘলা দিন, লাইটপোস্টেরে জীবনে। অথচ রোদ ছিল। আলো ছড়িয়ে ছিল সবখানে। ঝুমুরের সাথে তার নতুন পুরুষ। বিস্ময়ে হতবুদ্ধি লাইটপোস্টের চোখের নিচে বসে ছিলো তারা, অনেকক্ষণ। এবং চুমু খেয়েছিল। বুকভাঙা লাইটপোস্টটি মনে মনে অনেক গল্প বানিয়েছে প্রতিদিন। তার কিছু করারও ছিল না। প্রতিটি গল্পের কেন্দ্রে ছিল রাজন ও ঝুমুর, পাড়ভাঙা নদীর তীব্রস্রোতের উপাখ্যান ছড়িয়ে ছিল গল্পের ডালপালায়। তার হৃদয় একবার ভাঙেনি ওরা। নদীরই মতো, একটুখানি ভেঙে গিয়ে চুপচাপ নদী যেমনটা সরে যায় না কোনদিন। রাজনের হৃদয়ও হাতবদল হয়েছে বহুবার। মিলি, শান্তা, লুবনা… ঝুমুরের হৃদয়ও স্থির থাকেনি একটাই বন্দরে। পার্থ, আবির, রাফসান…। শুধু-ই ঘাটে ঘাটে নোঙর। অশান্তি। স্রোতের মর্জিতে ভেসেছে শুধু। আজ এতদিন পরে, সম্ভবত অনেক বছর পরে ঝুমুরকে আবার দেখা গেল। পার্ক বদলেছে, পার্কে আসা মানুষের মুখগুলো বদলে গেছে। বদলেছে প্রেমের ধরন ও ধারনা। ঝুমুরও কি বদলায়নি! বদলেছে হয়তো। বহু বছর পরে, হারানো আত্মজাকে দেখে আত্মসন্তুষ্টির হাসিতে মাতালপ্রায় বৃদ্ধ লাইটপোস্টটি কিছু একটা খুঁজছিল মনে মনে। কি সেটা? নিজেও বোধ করি জানে না সে। সম্ভবত রাজনকে দেখতে চাইছিলো ঝুমুরের পাশে। আজ শহরে কোনো উৎসব হচ্ছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও লাইটপোস্টটি এরকম দিনে শহরের উত্তাপ টের পায়। অভ্যেস হয়ে গেছে। তাকে খুব বেশি খুঁজতে হয়নি, তার আগেই রাজনকে দেখা গেল একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে তার নিজস্ব মেয়েমানুষ। নিয়তিলিখিত এই কাকতালে বিস্মিত হয় লাইটপোস্টটি। এবং আনন্দিতও। আজ মানুষের জীবনের জটিলতম ধাঁধাঁর সমাধান হতে পারে, তার-ই একমাত্র চোখের সামনে। ঝুমুর দেখতে পেয়েছিল রাজনকে। সম্ভবত রাজনও ঝুমুরকে দেখেছে। ঝুমুরের স্বামীটি একটু পরে উঠে চলে যায়। হয়তো স্ত্রীর জন্য কিছু কিনে আনতে গেছেন। রাজনও তার বউটিকে বসিয়ে রেখে একটু ঘুরে ঝুমুরের পাশে এসে বসে পড়ে। দ্বিখন্ডিত তৈলচিত্রটি হঠাৎই চোখের সামনে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে আবার। এরকম সময়ে শহরে লোডশেডিং নেমে আসে কিংবা লাইটপোস্টটিই হয়তো তার আকাঙ্খার পূর্ণতায় বিস্ফারিত হয়। অকস্মাৎ নেমে আসা অন্ধকারে ডুবে গিয়ে দুই প্রাক্তন প্রেমী কি করেছিল জানা নেই। হয়তো তারা একে অপরকে খুব একাগ্র্রতায় চুমু খেয়েছিল। কিংবা এমনও হতে পারে চুমু খেতে ঠোঁট এগিয়ে দিযেও অসম্পূর্ণ চুমুর ফাঁপা আর শীতল জায়গাটি ভরিয়ে দিয়েছিল তীব্রতম জড়িয়ে ধরা অঝোর কান্নায়। হতে পারে এমনটা। না-ও হতে পারে। লাইটপোস্টটি মরে যাবার পর এই ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। অনুমানে বলছি…
আরও পড়ুন: রবিবারের ছোটগল্প রাজার ফাঁদ লিখেছেন সসীম কুমার বাড়ৈ

Check Also

রাজস্থানের ভৌতিক গ্রাম

রাজস্থানের রহস্যময় কিরারু গ্রাম

দেবশ্রী চক্রবর্তী: ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত একখন্ড মরুপ্রান্তরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে রহস্য এবং রোমাঞ্চ। …