অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের একক অভিনয়
দেবজ্যোতি কর্মকার
গত ২৬ ডিসেম্বর নদিয়ার করিমপুর জগন্নাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল অরুণ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত নাটক ‘ কিছু বিচিত্র সিম্ফনি ‘। নাটকটির রচয়িতা অভিনেতা নিজেই। ১৯৭৫ এ লেখা নাটকটিতে প্রায় ৩৫ টি চরিত্র ছিল। তখন তিনি নিজেই একক অভিনয় করেছেন সবকটি চরিত্রে। আজও তিনি একক অভিনয়ে মুগ্ধ করলেন আমাদের, এই ৭৫ বছর বয়সেও! তবে এবারের নাটকে মাত্র তিনটি মূল চরিত্রে অভিনয় করলেন অরুণবাবু।
এই নাট্যকার আসলে একজন কবি। নাটকের সংলাপ তাই কবিতার মতোই। ইতালির বিখ্যাত নাট্যকার লিউজিপিরান্দলো এবং বিখ্যাত অভিনেতা হেনরি দ্য ফোর্থ এই দুই জটিল চরিত্র নিয়ে নাটকের শুরু। নিঁখুত ও স্পষ্ট উচ্চারণে সাবলীলভাবে অভিনয় করলেন এই নাট্যকার। কোথাও এতটুকু জড়তা ও বার্ধক্যের ছাপ নেই। যেন কোনও মধ্য তিরিশের তরুণ চিৎকার করলেন, মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ালেন মিনিট চল্লিশের সময়।
নাটকের বিষয় ছিল ভীষণ জটিল। শিল্প এবং শিল্পীর অসহায়তা। আবার অভিনেতার দ্বিতীয় ভাগে ঋত্বিক ঘটকের চরিত্রে ছিল শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা।
এরকম একটি জটিল নাটক মূলত কবিতা। তাকে মঞ্চস্থ করার সাহস দেখালো আয়োজক ‘ করিমপুর মুক্তধারা ‘।
নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুহূর্তে এক চরিত্র থেকে আরেকটি চরিত্রে নিজেকে অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেছেন অরুণবাবু। কণ্ঠ তাঁর বরাবরই তীব্র। আগেও একক অভিনয়ের জন্য রাজ্যে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন। এদিনও যেন তিনি নিজেই তাঁর প্রতিযোগী।
লিউজিপিরান্দলো যিনি নোবেল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, যিনি শুধুমাত্র নাটকের জন্য নির্বাসনে ছিলেন, দিনের পর দিন উন্মাদ সহধর্মিনীর সঙ্গে ঘর করেছেন। তাঁরই নাটকের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হেনরি একসময় এই শিল্প যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চেয়েছেন। অথচ মুক্তিই একমাত্র শিল্পের যন্ত্রণা থেকে দূরে থাকার আশ্রয় নয় একথা বলেছেন লিউজিপিরান্দলো। তবুও হেনরির জেদে একসময় তাঁকে মুক্ত করেছেন। মঞ্চ যাঁর কাছে ঈশ্বর, যিনি বাইবেল মানেন না তাঁর পক্ষে এই মঞ্চ ছেড়ে যাওয়া যাকে আবার তিনি নিজেই শিল্পের মুক্তি হিসেবে ভেবেছেন কতটা বেদনার এই অনুভব করা একজন প্রকৃত শিল্পী ছাড়া অসম্ভব। সেই হেনরি যিনি পৃথিবীর সব থেকে জটিল নাট্যকারের নাটকের অভিনেতা।পৃথিবীর বিখ্যাত অভিনেতা যিনি বিদায়কালে বলেছেন, ‘ ক্ষমা কোরো হে দর্শক, ক্ষমা কোরো হে আলো, গ্রীণরুম!’ অরুণ চট্টোপাধ্যায় এই সংলাপ বলেছেন আর আমরা কেঁদেই চলেছি!
দ্বিতীয় এককে আমাদের তথাকথিত শিল্প জগতে সবচেয়ে ব্যর্থ মানুষটি অর্থাৎ ঋত্বিক ঘটক মঞ্চে এসেছেন তাঁর প্রিয় দেশি বোতলটি নিয়ে। আর কন্ঠে ঢেকুর তুলেছেন নিজস্ব ঘরানায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে। সেই ঋত্বিক ঘটক যাঁকে আমরা কোনওদিন চিনতে পারিনি। তাইতো সমাজটাকে ‘সমবেত শুয়োরের বাচ্চারা ‘বলে সম্বোধন করেছেন। আমাদের মোটা চামড়া তা ভেদ করেনি অবশ্য। মঞ্চে চিৎকার করছেন ঋত্বিক ‘ হে তরুণ কবি, হে তরুণ শিল্পী তোমরা শিল্পের কাছে নত হও, শিল্পের কাছে সৎ থেকো অন্তত ‘। হজম করা মুশকিল হলেও এই সংলাপ আমাদের প্রাণিত করেছে। অকপটে বলতে পেরেছেন এই বৃদ্ধ অভিনেতা। আমরা যদি এতটুকুও বুঝি তবে সত্যিই একদিন শিল্পের-যন্ত্রণাই আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় হবে। শিল্পীকে তাঁর শিল্পের কাছে সৎ থাকার মন্ত্রটা আমাদের পাঠ করালেন সেদিন অরুণ চট্টোপাধ্যায়। আমরাও মগ্ন উচ্চারণের কাছে নত হয়ে বসে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ।
আরও পড়ুন:রবিবারের গল্প পুজামৈত্রের ছায়ালাপ