সুমনা দাস দত্ত: পয়লা বৈশাখ বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সকালে পাট ভাঙা জামা-কাপড়, দুপুরে কাঁসার থালার পাশে হরেক কিসিমের বাটি ভর্তি ব্যঞ্জন, মিষ্টির হাঁড়ি, দই-এর ভাঁড়। বিকেলে দোকানে দোকানে হালখাতার ক্যালেন্ডার, জিলিপির প্যাকেট নিয়ম করে সংগ্রহ। বাড়ি ফিরে ক্যালেন্ডারের ছবি নিয়ে উন্মাদনা। আর মনে দুকলি গান ভাঁজা, “এসো হে বৈশাখ এসো এসো”-বাঙালির পয়লা বৈশাখ মানে একটা নস্টালজিয়া। নস্টালজিক মুহূর্তকে আরো সুন্দরতর করে তোলে ক্যালেন্ডারের এই লাল কালির তারিখটি।
একটা ছুটির দিন। একটা বছরের শুরুর দিন, ব্যবসায় পুরনো হিসেব-টিসেব মিলিয়ে নতুন খাতা। শুধু কি এটুকু-ই? না। পয়লা বৈশাখ মানে এটুকুই নয়। আমরা দেখে নেব পয়লা বৈশাখকে জড়িয়ে থাকা কিছু তথ্য, ইতিহাস এবং আবেগ।
বাংলা মাস ও বারের প্রত্যেক নামই নক্ষত্রমণ্ডলের চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। বৈশাখ মাসও তার ব্যতিক্রম নয়। বৈশাখ মাসের নামকরণটি হয়েছে বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে। এই মাসটিকে মানদন্ড করে শুরু হয় বাংলা সনের সময় তারিখ নির্ণয়। এই বাংলা সনকে আমরা বঙ্গাব্দও বলি। আসলে ‘সন’ একটি আরবি শব্দ। এই শব্দটি এবং বাংলা ক্যালেন্ডারের আরো কিছু ভুল সংশোধনের জন্য ১৯৬৬ সালে ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর নেতৃত্বে বাংলা একডেমী কর্তৃক উদ্যোগ নেওয়া হয়।
প্রতিটি জাতি ও সভ্যতা নিজেদের সংস্কৃতির মাধ্যমে খুঁজে পায় তার নিজস্ব রুট। স্বকীয় বৈশিষ্ট ও নিজস্ব অনুভূতি। পয়লা বৈশাখকে ঘিরেও তাই বাঙালী মননে ছাপ ফেলে যায় বাংলার কালচার। পয়লা বৈশাখকে অনেকে ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি’ বলে প্রচার করে পঙ্গু করতে চেয়েছে বাঙালী সংস্কৃতিকে। বাংলা সংস্কৃতির উপর কালো পর্দা টেনে দিয়ে সমসাময়িক ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী বাঙালী সংস্কৃতির মূলে আঘাত করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পাকিস্তান সরকারের এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’-এর সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান জানায়। পয়লা বৈশাখ সূর্যোদয়ের পর পর ছায়ানটের শিল্পীরা ১৯৬৫ সালের ১৪ই এপ্রিল(১লা বৈশাখ বাংলা ১৩৭২সন) রমনার বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের “এসো হে বৈশাখ” গানটি গেয়ে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করেন। বস্তুত তখন থেকেই পয়লা বৈশাখ একটি উদযাপনেরও দিন হয়ে ওঠে।
আরো পিছিয়ে ইতিহাসের কাছে পয়লা বৈশাখ সম্পর্কে জানতে চাইলে, উত্তরের সাথে সাথে মানবিকতার আরো এক ইতিহাস উঠে আস। যেখানে শুধুই মানুষ মুখ্য হয়ে ওঠ। তার আগে আমরা জেনে নেব এই বাংলা নববর্ষের প্রয়োজনীয়তা হলো কেন? আমাদের কৃষি নির্ভর ভারতবর্ষের মূল আয় ছিল কৃষি কেন্দ্রিক।এ দেশের শাসকদল ও কৃষির উপরই দাঁড়িয়ে ছিল।পুরো রাজ্যই জমিদার, কৃষি আর জমি এর মধ্যেই আবর্তিত ছিলো। কৃষকদের থেকে খজনা আদায় করেই সামন্ততান্ত্রিক মূল কাঠামো টিকে ছিলো। আর ফসল ফলানোর ক্ষেত্রে ঋতুর উপর নির্ভরশীল থাকতেই হতো। মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলতো না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। তাতে কৃষকরাও খুব অসুবিধায় পড়তো। সমাজে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরী হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
আকবরের সময়কাল থেকেই পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এরপর সন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল হালখাতা। এই হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বইএর ধারবাকী সব মিটিয়ে। নতুন করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনো প্রচলিত আছেl
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পয়লা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ১৯৬৫ সালের আগে ঘটা করে পয়লা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় বাংলা নববর্ষের গানের উল্লেখ পাওয়া যায়, ”আইল নতুন বছর লইয়া নব সাজ, কুঞ্জে ডাকে কোকিল-কেকা বনে গন্ধরাজ”।
এ ভাবেই ইতিহাসকে সাথে নিয়ে ‘পয়লা বৈশাখ’ বাঙালীর হৃদয়ে শুকিয়ে আসতে থাকা বাঙালী কালচারের মরুভূমিতে একটুকরো মরুদ্যান হয়ে আছে। “এভাবেই এসো হে বৈশাখ” বাঙালীর পাট ভাঙা শাড়িতে, হালখাতাতে, গুরুজনের পায়ে হাত দেওয়া প্রণামে। আর বড় দের ‘মানুষ হয়ে ওঠো’ এই আশীর্বাদে।
আরও পড়ুন: রবিবারের ছোটগল্প প্রতিপক্ষ লিখেছেন পূজা মৈত্র
Check Also
শিক্ষকের ধর্ষণে মা ৭ম শ্রেনির ছাত্রী, চাচার ধর্ষণে মা ভাতিজি
কুমিল্লায় ধর্ষণ – শিক্ষক কিংবা নিকট আত্মীয় কারো কাছেই কি নিরাপত্তা নয় নারীরা?কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে কোচিং …