Home / জীবনী / সৃষ্টি সুখের উল্লাসে বাউন্ডুলে কবি নজরুল

সৃষ্টি সুখের উল্লাসে বাউন্ডুলে কবি নজরুল

সুমনা দাসদত্ত: জীবনের চেনা ছকে কখনোই তাকে ধরা যাবে না। ছক ভাঙা জীবনের শিরোনাম হয়ে উঠে আসে এই বিদ্রোহী কবির নাম। কবি নজরুল ইসলামের একমাত্র অধিকার “বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী” লেখার। তাঁর জীবনের বাউন্ডুলেপনার শুরু কবে থেকে? সেই যখন বাচ্চারা বই বগলে স্কুলের পথে হাঁটা দেয় সেই বয়স থেকেই কবির বাউন্ডুলে জীবন শুরু। জীবনের চির চেনা ছক ভেঙে পালিয়ে গেলেন ‘লেটো’ দলের সঙ্গে। বয়েস আর কত হবে? দশ কি এগারো। ন’বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কাজের খোঁজে লেগে গেলেন, লেখা পড়ায় আপাতত বিরতি। তিনি হয়ে গেলেন হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক। কিন্তু ওই যে “হেথা নয় হেথা নয় অন্য কনো খানে”র খোঁজে মাত্র এগারো বছরে যোগ দিলেন ‘লেটো’র দলে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে নানা জা্য়গা দেখা আর মুখে মুখেই গান বাঁধা, বেশ মজার জীবন। চলতি হাওয়ার পন্থি হয়েই দিনগুজরান হচ্ছিল বেশ। তাঁর তৈরি লেটো গানগুলিও জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল তখন, তবুও মন টিকলো না। আবার পালিয়ে গেলেন ১৯১০ সালে দুখু মিঁয়া লেটো দল ছেড়ে এবার পড়াশুনার তাগিদ অনুভব করলেন। ভর্তি হলেন রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে কিন্তু আর্থিক অভাবের কারণে পড়াশুনা আর এগলো না। আবার সব ছেড়ে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। না, এখানেও খুঁজে পাওয়া গেলো না নিজেকে স্থায়ী করনের চাবিকাঠি। চুলোয় যাক কবিগান, তিনি এখান থেকে বেরিয়ে একজন খ্রীষ্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা হয়ে গেলেন। ধুর এভাবেও কি জীবন চলে নাকি? আবারো পালিয়ে তিনি কাজ নিলেন আসানসোলের এক চা’য়ের দোকানে। মন বসতে চায় না এখানেও, কিন্তু পেট বড় বালাই কাজ না করলে পেট চলবে কি করে? ভাগ্যক্রমে পরিচয় হয় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ’র সাথে। তিনি কবির প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ১৯১৪ সালে আবার ভর্তি করে দেন স্কুলে। এবার বোধহয় ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হলেন। ১৯১৭ সাল। সামনেই কবির স্কুল ফাইনাল। পড়াশুনাও মন্দ গতিতে এগোচ্ছে না, কবির জীবন বেশ স্থিতিশীল। এই পরিস্থিতিতে কবির ভাগ্যলক্ষ্মী আড়ালে হাসলেন! একদিকে কবির সামনে পরীক্ষা অন্যদিকে দেশে যুদ্ধের হাওয়া! এসময় কি কবির পক্ষে মাথা ঝুঁকিয়ে বইমুখী হয়ে থাকা সম্ভব? দিলেন না তিনি মাধ্যমিকের প্রিটেষ্ট, পালিয়ে গেলেন! সেই সময়ে, ঠিক যেখানে তাঁকে দরকার। যোগ দিলেন ইউনিট ৪নং বাঙ্গালী পল্টনের সেনা বিভাগে। যুদ্ধকৌশল রপ্ত করতে করতেই লিখে ফেললেন, ’মুক্তি’, কবিতা সমাধি’ ‘রিক্তের বেদন’, ‘ব্যথার দান’, ‘হেনা’ নামের ব্যাতিক্রমী বিস্ময়কর সব রচনা। এগুলি পাঠক মহলে আসতেই পাঠকগণ বুঝতে পারছিলেন যে বাংলা সাহিত্যের আকাশে নতুন এক নক্ষত্রের জন্ম হল। যে নক্ষত্রের দা্হ্য শক্তি বেশ জোরালো। জীবনের এতো ওঠা নামা কবি জীবনের সৃষ্টি সুখের উল্লাসকে কখোনোই থামাতে পারেনি। সেনাবিভাগ ছেড়ে তিনি কোলকাতায় এসে টুকটাক সাংবাদিকতা, লেখালিখি করছেন। তখন তাঁর ঠিকানা ছিলো ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যালয় ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটে।মাস পাঁচ ছয় পরে কাউকে কিছু না বলে নিখোঁজ হলেন। ব্যাপারটা কি হলো জানতে নজরুলের ঘনিষ্ঠতম এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু গায়ক শ্রী নলীনিকান্ত সরকারের কাছে আসেন। আসলে বাউন্ডুলে জীবনের কিছু খসড়া নথিপত্র এই বন্ধুর কাছে পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারে এই ভেবে তাঁকে জিজ্ঞেস করাতে, তিনি যা বললেন তার মর্ম হল এই যে, আগের দিন বিকেল পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে সকালে কবিকে তিনিই খুঁজে পাননি। এই ব্যাপারটা কবির সহকক্ষবাসীকে বলতেই সে জানালো ‘সে তো কাল রাত্তিরে কুমিল্লা চলে গেছে’ কবির গায়ক বন্ধু বলেছিলেন, ‘কৈ কাল তো কিছু বললে না?’ সহকক্ষবাসী বলল যে, ‘বলবে কি করে কাল সন্ধ্যার পর একভদ্রলোক এসে কি বললেন, সঙ্গে সঙ্গে কুমিল্লা যাবার জন্য শিয়ালদা স্টেশনে ছুটলেন’। এই ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
কবি নজরুল
কাল কি হবে, কোথায় থাকবেন তা তিনি নিজেও জানতেন না। পালিয়ে যাবার আরেকটি উদাহরণ না দিলেই নয়। সালটা ১৯২১। নানা ঝুটঝামেলার মধ্যেও কবির জীবনে বসন্ত এলো, কবি প্রেমে পড়লেন সাদিয়া খাতুন ওরফে নার্গিস বেগমের। এই প্রেম পরিণয়ে পৌঁছতে বেশি সময় নেয়নি। তবে চালচুলোহীন কবি যে কিভাবে সংসার চালাবে তা নিয়ে কবির বন্ধুমহলও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। এসবকে পাত্তা না দিয়েই, হাজার ঝুট ঝামেলার মধ্যেও বিয়ের দিন এসে গেল। কবি বিয়ের জন্য প্রস্তুত হলেও মনের মধ্যে একটু খুঁতখুঁত করছিলেন। মেয়ে পক্ষের অভিভাবক, কবির হবু মামা শ্বশুরের কিছু আচরণ কবিকে মানসিকভাবে আঘাত করেছিলো। কিন্তু কিছু বলতেও পারছিলেন না কবি তাকে। কারণ তাঁর আশ্রয়ে থাকাকালীনই এই প্রেম। বিবাহের দিন আর সহ্য হলো না, কবিকে বলা হলো বিয়ের পর দৌলতপুরের শ্বশুরবাড়িতেই কবিকে থাকতে হবে। কবি এটা মানতে পারলেন না, প্রিয়তমা নার্গিসকে বললেন, তাঁর সাথে চলে যেতে। বাড়ির অমতে এই সিদ্ধান্ত নেবার সাহস দেখাতে পারেননি নার্গিসদেবী। লোকচার মেনে নির্বিঘ্নে হয়ে গেল বিয়ে। কিন্তু সেই রাতেই কবি সব বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে গেলেন দৌলতপুর ছেড়ে। তবে এটুকু বোঝা যায়, এই বাঁধন ছিঁড়তে তার হৃদয়ের সবকটা শিরা উপশিরা ছিঁড়ে রেখে আসতে হয়েছিল দৌলতপুরের ওই সান্ধ্যঅনুষ্ঠানে। এদিকে নার্গিসদেবী কবির প্রথম স্ত্রী তো হয়ে গেলেন কিন্তু ঘরণী হয়ে উঠতে পারলেন না। বাউন্ডুলে এই জীবনকে কিছুদিন ঘরের শান্তি দিয়েছিলেন কবির দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমিলা। এভাবেই কবি একজীবন থেকে আরেকজীবনে ছুটে গেছেন, কখনো পালিয়ে গেছেন। তবে এ পালানোকে আমরা কখনোই দায়িত্ব এড়ানোর ফিকির বলে কবিকে ছোটো করতে পারি না। তিনি এতবার কর্মজীবন, ব্যক্তিজীবনের ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন তার পিছনে কোনদিনই ব্যক্তিস্বার্থ ছিলো না। এই কারণেই তিনি বিদ্রোহী কবি। পৃথিবীর যা কিছু অন্যায় তার বিরুদ্ধেই জোরালো লেখনী দিয়ে প্রতিবাদীকণ্ঠ সোচ্চার হয়েছে।

কবি কাজি নজরুল ইসলাম
Illustration: Preety Deb
১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ, কবির হাতে তেমন কাজও নেই। এই অবস্থায় বাঙ্গালী পল্টন ভেঙ্গে যাওয়ার গুজবে অধীর হয়ে উঠলেন। তল্পিতল্পা বেঁধে আবারো পালিয়ে যাবার চেষ্টা। অনেক নজরুল গবেষক এই ঘটনাটিতে কবির ভবিষ্যৎ চিন্তার দিকটি তুলে ধরেছেন। ভবিষ্যত চিন্তায় অধীর হয়েই তিনি নাকি কাজের খোঁজে সেনাবিভাগ ত্যাগ করে কলকাতায় আসেন। আমরা কবির যে যাপন এতক্ষণ দেখলাম তাতে এই ব্যখ্যায় মন সায় দেয় না। এই সেনা বিভাগের কাজ ছাড়ার পিছনে কবির ভবিষ্যৎ চিন্তা আদৌ কি ছিলো? মনে তো হয় না। আগে আগেও তো অনেকবার মনুষের স্বাভাবিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানকে তুড়ি মেরে জীবনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ভেসে গেছেন। কবিকে কখনোই নিজের কি হবে এরকম ভাবতে দেখিনি। বরং নিজেকে ঠেলে দিয়েছেন বেশি অনিশ্চিয়তার দিকে, দশের ভালোর দিকে, দেশের ভালোর দিকে। তবে ১৯২৯ সালে সত্যি সত্যিই পল্টন ভেঙ্গে যায়। তার আগেই এতো আলোচনা সমলোচনার জায়গা ছেড়ে চলে এসেছেন কলকাতায়, কবি “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”তে কাজ নেন। এখান থেকেই তার টুকিটাকি সাংবাদিকতার ও পুরো মাত্রায় লেখালেখির কাজে নিজেকে নিয়োগ করেন। এই বছরই নবযুগ পত্রিকায় “মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। কিন্তু তিনি যে নজরুল ইসলাম। তাই পিছুহটা তো দূরের কথা আরো ডুবিয়ে দিলেন নিজেকে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনে। সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একইসাথে মুজফ্‌ফর আহমদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতচর্চাও চলছিল একাধারে। পুলিশী নজরদারিকে তোয়াক্কা না করে ১৯২১ সালে ভারতব্যাপী হরতাল উপলক্ষে নজরুল পথে নেমে পড়লেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। এই হলেন নজরুল ইসলাম। নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় তার নেই। ১৯২২ সালে “বিদ্রোহী” কবিতাটি প্রকাশ পায়। বিদ্রোহী কবিতাটিই কবিকে “বিদ্রোহী কবির” খ্যাতি এনে দেয়। কিন্তু রাজশক্তির টনক নড়ে ওঠে একে থামাতে না পারলে নিজেদের মসনদ জ্বলবে বিদ্রোহের আগুনে। যুববাণীতে প্রকাশিত ৮ই নভেম্বর সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ২৩ নভেম্বর যুগবাণী প্রবন্ধ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং ওই দিনই তাঁকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৩ সালে ১৬ই জানুয়রি বিচারের পর তাঁকে একবছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ২২) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন। এই ভাবেই কবি নিজের জীবনের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে-ই মেতে থেকেছেন আর আমাদের মতো পাঠকের কাছে রেখে গেছেন রক্তে আগুন ধরিয়ে দেবার মতো প্রতিবাদী কবিতা- “যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।”
আরও পড়ুন: জাকারবার্গের জীবনী ( Mark Zuckerberg Success Story in Bangla )

Check Also

zuckerberg

জাকারবার্গের জীবনী ( Mark Zuckerberg Success Story in Bangla )

সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট, ফেসবুকের কো-ফাউন্ডার এবং সিইও মার্ক জুকারবার্গ বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ধনকুবেরের একজন। শুরুর দিকের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *