সদ্য প্রয়াত কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত মানুষকে ভালোবেসে সব কিছু করে দিতে পারতেন
জুবিন ঘোষ
কবির প্রেম হু-হু, শিরশির… বিষাদের স্যাঁতস্যাঁতে সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম। হবো হবো করছে বাট হচ্ছে না, হলেও বিহাইন্ড দ্য এনিমি লাইন। অনেকটা বাড়িতে একটা হুষ্টপুষ্ট গোরু আছে যেটা দুধ দিচ্ছে না। কিন্তু উত্তাল। প্রেমিকা এল কবিকে দেখেই, প্রেমিকার ইনফ্যাচুয়েশন ‘কবি মাল’-টার কবিত্বে কিছুদিন ভিবজিও মার্কা সংশ্লেষ সুড়সুড়ি দিলেও, যেই ‘ভবি’ ‘ভবি’ (ভবিষ্যতের আদুরে নাম, অনেকটা হাজ্ব্যান্ডের হাবুর মত) ভাবনাটা আসছে যখন তখনই প্রেম নিপাত হল ভবানন্দের চরণে। মানে যারপরনাই হাবুডুবু সাঁতরালেও ‘হাবু’ হওয়া হল না কবির। প্রেমিক না থাকলে কী হবে, যে কোনও কবির নিখাদ প্রেমিক-প্রেমিক মুরুব্বিপনাটা কিন্তু সেই আরশোলার যুগ থেকে জিয়িয়ে রেখেছে। আমার ললাটটা মনে হয় জন্ম থেকেই কেউ পয়েন্ট জিরো রেঞ্জ থেকে এক সিকি সমান গর্ত করে দিয়েছিল, প্রেমস্য আপেলত্ব না পেলেও যে কোনও কবির প্রেমে আমি অনেকান্ত হয়ে যাই। প্রেমিক কবিকে নিঃস্বার্থ পরিণতি দিতে গিয়ে কখনও সপাটও খেতে হয়েছে কখনও কপাটও। তথাপি দমিনি। কিন্তু তা বলে প্রেমিক কবি প্রেমিকার পরিচয় জানে না, নাম ছাড়া ধাম পাতা নেই, কিন্তু ছ-শতক মাইল ছুটে যাবে এহেন অভিজ্ঞতাও যে প্রাপ্তি হবে তা কে জানত! সেও কবি কাহিনি, এক অন্য প্রেমের রুপকথার দিকে পাড়ি জমানো ফ্যালাসি… এখানে হাবুডুবুটাও হল, হাবুটাও হল স্মুচলি…
চেকোশ্লোভাকিয়ার ‘ওরা পাঁচজন’ উপকথায় যেমন পঞ্চভূতকে সঙ্গে নিয়ে রাজকুমার বাপ-মা মরা রাজকুমারীকে শুধুমাত্র ছবিতে দেখে পছন্দ হয়ে যেতে, রাজকুমারের ‘উঠল বাঈ তো কটক যাই’-এর মত শত শত মাইল দূরের অজানা দেশে পাড়ি দিয়ে উদ্ধার ও বিয়ে করতে গেছিল, তেমনি আমরাও শুধুমাত্র ফেসবুকে ছবির ভরসায় বাপ-মা’হারা রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে রাজকুমারকে সঙ্গে নিয়ে পঞ্চভূতের একজন হয়ে পাক্কা ৫৫০ কি.মি পথ অতিক্রম করলাম হুগলি শিল্পাঞ্চল থেকে অজানা পাহাড়ি প্রদেশে। এর ফলে বাংলা সাহিত্যে যে মিথটার জন্ম হল তার রাজকুমার নির্বাচিত হলেন কৃত্তিবাস পুরস্কারপ্রাপ্ত ৯-এর দশকের তরুণ কবি অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি সেখানে নিতান্ত পার্শ্বচরিত্র — জাস্ট পঞ্চভূতের একজন। এরচেয়ে বেশি বাউণ্ডুলেপনা সাহিত্য-পরিমণ্ডলে কেউ দেখিয়েছে বলে মনে হয় না। সেদিন হঠাৎ অয়ন’দা বলল, তাঁর নাকি ফেসবুকের শুভ্রা আচার্য নামের এক সুশীলা মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়ে গেছে, কিন্তু তার বাবার নাম আর এলাকা শিলিগুড়ির নকসালবাড়ি এলাকায় বাড়ি ভিন্ন আর কিছু অয়ন’দার জানা নেই। বোঝো কাণ্ডখানা ! শুভ্রা’দিকে নাকি অয়ন’দা কথা দিয়ে দিয়েছেন তিনদিনের মধ্যে অয়ন’দা নিজের মাকে নিয়ে ‘বাই কার’ নকসালবাড়ি যাবে বিয়ের কথাবার্তা বলতে। অয়ন’দা অনুরোধ করল আমার হাতে যদি টাইম থাকে তাহলে যেন অয়ন’দার সঙ্গী হই। বেড়ানোর নাম শুনলে বাউণ্ডুলেদের হাতে টাইম আর স্পেস দুটো এমনিতেই ইলাস্ট্রিকের মত বড় হয়ে যায়। এমন একটা এক্সপেডিশনের নাম করলে কি কেউ ছাড়ে ! কিন্তু নকসালবাড়ি শুনেই বুকটা ধক করে উঠল। চারু মজুমদারের একদা বাংলার সব’চে রাজনৈতিক অশান্ত জায়গা। আচার্যিবাড়ির মেয়েটাও নাকি তার জ্যাঠা-জ্যেঠিমাকে আমাদের আসার কথা বলতে পারবে না। ইভেন শুভ্রা’দি মানে তৎকালীন হবু বউ সেই রাজকন্যা কিন্তু বিশ্বাসই করেনি যে তিনদিনের মধ্যে আমরা যাব, ব্যাপারটা তিনি নিছকই ইয়ার্কি হিসেবেই নিয়েছিলেন।
ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম, পঞ্চভূতের না-হয় ঢ্যাঙা-ভূত ছিল, এখানে অয়ন’দার হালকা জলপাইরঙের জেন গাড়িটাই ঢ্যাঙা-ভূত যে এই ৬০০ কিমি পথটা পাড়ি জমাবে। রাজকুমার অয়ন’দার সঙ্গে বাকি চারজন আমি, জেম্মা (অয়ন’দার মা), অয়ন’দার কাকিমা, ড্রাইভার সুনীল’দা। অর্থাৎ এরাই বাকি চার ভূত ! তেল ভরা হল ৩০০০ টাকার প্রায়। অচিরেই NH-34 ধরে গাড়ি যত এগোচ্ছে তত টেনশন বাড়ছে সবারই। সবাই চাইছে সম্পর্কটা ভালয় ভালয় হয়ে যাক, কিন্তু এভাবে কোনও খবর না-দিয়ে যাওয়া, অচেনা জায়গা কে-কীভাবে নেবে সেটাই ভাবনা! আমরা যতটা তাড়াতাড়ি পৌঁছব ভেবেছিলাম, বাস্তবে রাস্তা তারচেয়েও খারাপ। ন্যাশানাল হাইওয়ে নাকি মালভূমি!—(দুয়েক দিন পরই আনন্দবাজারে দেখলাম মুখ্যমন্ত্রীও স্বয়ং ঐ একই সড়কপথে গিয়ে নিজের সাম্রাজ্যের রাস্তা সম্পর্কে হাড়েমজ্জায় সরোজমিনে টের পেয়েছেন ও রাগারাগি করেছেন। –মনে মনে যারপরনাই আপ্লুত হয়েছিলুম, দ্যাখ্ কেমন লাগে টাইপের)।
এতটা রাস্তা; অয়ন’দার কষ্টও হচ্ছে, আবার অয়ন’দার সামনে বসাই অভ্যেস, ঠিক করে পিঠ হেলাতেও পারছে না, আবার পিঠে ব্যথাও হচ্ছে। ব্যাপারটা অনেকটা টেম্পল রানের মত, তিনদিন টাইম, এই তিনদিনে পৌঁছতে হবে, আবার পৌঁছলেই হবে না, বাড়ি খুঁজতে হবে, প্লাস প্রেম নিবেদনটাও করতে হবে। আগে রাজকুমারিদের স্বয়ম্বর সভাতেও এর থেকে সহজ টাস্ক থাকত মনে হয়। ২০১৫ সালের সেই ‘আগস্টমাসের রাস্তা’ (কবি রানা রায়চৌধুরী বর্ণিত) দিয়ে ফারাক্কা পেরিয়ে যেতেই তুমুল বৃষ্টি। রাত হয়ে আসতে থেকে গেলাম রায়গঞ্জে, খুব সম্ভব কনিষ্ক লজে। ৬০০/- করে দুটো এসি রুমে তরকা-রুটি খেয়ে রাতে আমি-অয়ন’দা একঘরে জমিয়ে আড্ডা। দ্বিতীয় দিন গাড়ি আটকে গেল ডালখোলার বিশ্ববিখ্যাত জ্যামে। সঙ্গে বৃষ্টি। অবশেষে শিলিগুড়ি পৌঁছতে ‘সচিত্র’ হোটেলে আশ্রয় নিলাম। ঘর ভাড়া ৯০০টাকা। সচিত্র হোটেলে রাতে দেখা করতে এলো শিলিগুড়ির কবি রাজা রায়, আমাদের আসার খবরে শিলিগুড়ি পুলিশের উচ্চমহলের পদস্থ অফিসার কবি সুজিত দাস পরদিনের জন্য আর একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রাতে কনসাল্ট হল উত্তরবঙ্গের মানুষকে বুঝতে উত্তরবঙ্গের মানুষকেই দরকার, সকালে আমাদের গাড়িচালক সুনীল’দার সঙ্গে কেবল একা গাড়িতে বেড়িয়ে পড়লাম ধূপগুড়ি থেকে কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্তকে তুলে আনতে। আগেই ফোন করে দিয়েছিলম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি একসময় সেবক ব্রিজে আসতে মুষলধারে শুরু হল। বাঘপুলে রাস্তার দু’পাশের আদিম অরণ্যের অনন্ত ক্লোরোফিল চুঁয়িয়ে ঝরনা হয়ে নেমে আসছে আনন্দধারা। আহা সেকি উত্তরবঙ্গের দৃশ্য। চারপাসে পড়া চিরসবুজ পুরাতন বৃক্ষের পাহড়ি জঙ্গল; ভিজে রাস্তার পাশে ছোট ছোট বাদামি বানরগুলো যেন এই স্থানীয় ভাষার ‘লোহাপুল’-এর রক্ষাকর্তা।
ইউটিউবে দেখে এসেছিলাম, এখানেই মাত্র ১৬মাস আগে ২০১৩ এপ্রিলে মাথায় টিকি বেঁধে তিস্তা পার হতে গিয়ে প্রখ্যাত স্টান্টম্যান শৈলেন্দ্রনাথ রায় মাঝপথে আটকে গিয়ে শূন্যেই ঝুলে স্পটডেড হয়েছিলেন। বর্ষার খরস্রোতা তিস্তা যেন বলতে চাইছিল সেই-বা কেন মানবে, সামান্য ‘টিকির জোরে’ তাঁকে পার করে দেওয়া যাবে?
হঠাৎ বৃষ্টিতে তিস্তার পাশে দেখলাম ধ্বস নেমেছে। বাঁ-দিকের রাস্তা আটকে ডানদিকে একেকটা গাড়ি পার করিয়ে দিচ্ছে স্থানীয় মানুষ, ট্রাফিক আর রাস্তা সাড়াইকাররা। কোথাও কোথাও রেলিঙে স্পষ্ট দুর্ঘটনার চিহ্ন। ওদিকে সুনীল’দা অদ্ভুত মানুষ — রাস্তা ভুল করলেও কাউকে জিজ্ঞেস করেন না, আর যতক্ষণে জিজ্ঞাসা করলেন গাড়ি ততক্ষণে চাপরামারি জঙ্গলের পাশে। সেখানেও জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তার বৃষ্টির অপরূপ শোভা উপভোগ করলাম। দেখলাম তিন-চারজন বনরক্ষী হন্টনে জঙ্গল টহলে বেড়িয়েছে। আবার গাড়ি ঘুরিয়ে ধুপগুড়িতে ঢুকে পুণ্যশ্লোক’দাকে তুলে অবশেষে তাঁর গাইডে এবার মাত্র দেড় ঘন্টা লাগল। ওদিকে টেনশনে অয়ন’দা তাড়া দিচ্ছে খালি। পথে পুরো ব্যাপারটা আমার থেকে শুনে তো পুণ্যশ্লোক’দার চক্ষু চড়কগাছ। তারপর শান্ত মনে বলল ‘রিয়েল হিরো !’
পুনরায় শিলিগুড়ি পৌঁছে আর দেরি নয়, সুজিত’দার পাঠানো গাড়ি অপেক্ষাই করছিল। আমি পুণ্যশ্লোক’দা এক গাড়িতে। অবশেষে সেখানে পৌঁছে গেলাম। এবার বাড়ি খুঁজে বার করার পালা। বুঝতেও পারছি না শুভ্রা’দি আদৌ আমাদের কথা বিশ্বাস করেছে কিনা যে আমরা এসে গেছি ওদিকে অয়ন’দা ম্যাসেঞ্জারে মোটামুটি জানিয়ে দিয়েছে যে আমরা এসে গেছি। আসলে শুভ্রা’দি পড়েছে ফাঁপরে, প্রথমত তিনি ভাবছেন অয়ন’দা বুঝি ইয়ার্কি করছে, মাত্র এক সপ্তাহের আলাপে কেউ কি সারে পাঁচশো কিমি গাড়িতে ছুটে যেতে পারে! তাছাড়া প্রেমপর্ব তো জমলোই না, বিশুদ্ধ মজা নাকি নির্মম মজা কোনটা যে বিশ্বাসযোগ্য সেটাই বুঝতে পারছিল না শুভ্রা’দি। শুভ্রা’দির আর এক সমস্যা হল, যদি বা ‘আমরা আসছি’ কথাটা বিশ্বাস করেন, সেটা বাড়িতেই-বা কী করে বলবেন! জেঠুর কাছে মানুষ, কড়া শাসন, এমতাবস্থায় আমরা আসছি শুনলে অবশ্যই বাড়ির লোক ভাববে অনেকদিন ধরে প্রেম চলছে অনলাইনে যা কিনা আদৌ সত্য নয়। সেক্ষেত্রে শুভ্রা’দি দুই ঘা খেয়ে যাওয়াও আশ্চর্যের নয়। সেই সব ভাবনায় আমাদের পৌঁছানোর পরবর্তী অবস্থার কথাও ভাবাটাও খুব একটা প্রণিধানযোগ্য বলে বোধ হচ্ছে না। সুজিত’দা অত্যন্ত দ্রুত নিজে থেকেই গোয়েন্দা মারফত (আমাদের সেক্ষেত্রে কিছু বলতে হয়নি, উদ্যোগটা পুরোপুরি সুজিত’দার) খবর নিয়ে জানিয়েছে যে শুভ্রা’দি যথেষ্ট ভাল পাত্রী। এহেন অনেক দোলাচলে অবশ্য আমরা আসার আধ ঘন্টা আগেই শুভ্রা’দি কোনওমতে বাড়িতে জানিয়েই দিয়েছিল তাই রক্ষে নইলে আমরা যে কেন এতদূর ছুটে এসেছি সেটা শুভ্রা’দির বাড়িতে আমাদের গোটা ব্যাপারটা বোঝাতেই অনেক সময় লেগে যেত। তখনও তো জানি না শুভাদির বাড়ির লোকেরা কেমন, পরে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, নাহ, ডাণ্ডাতে নয় ঠান্ডাও হয়েছিলাম আইসক্রিম কোল্ড ড্রিংস খেয়ে অবশ্য যার সিংহভাগ কৃতিত্ব কবি ‘পুণ্যশ্লোক ম্যাজিকে’র।
আমরা নকশালবাড়ি ঢুকে যাকে জিজ্ঞাসা করছি সেই গদগদ হয়ে বলে দিচ্ছে কোথায় বাড়ি। এবার প্যালপিলিশন বাড়ছে। কেসটা কী ! সব লোকই তো চেনে ! তার মানে এটা দাঁড়ায় যে নিশ্চয় সম্ভ্রান্ত বাড়ির মেয়ে। মানে আমরা যে এসেছি সেটা এবার এখানকার মানুষ কেমনভাবে নেবে সেটাই দেখার। আর আমি আর পুণ্যশ্লোক’দা তখন প্ল্যান করছি বাড়িতে ঢোকার সময় কী জন্য এসেছি সেটা কীভাবে উত্থাপন করব। পুণ্যশ্লোক’দা ছিলেন অলয়েজ বি কুল। তিনি আশ্বাস দিচ্ছেন যে কিচ্ছু হবে না আমি আছি তো। বাড়ির কাছাকাছি আসতে দেখা গেল, সবাই কেমনভাবে যেন আমাদের দেখছে, পরে জানা গেল শুভ্রা’দি সময়মত সমস্তটাই জানিয়ে রেখেছিল। একজন গলির মুখ থেকে এগিয়ে এসে জানাল আমরা কাদের খুঁজছি, সেইমত আমাদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল, বাড়িতে ঢোকার মুখেই একচালা গৃহমন্দির, ভিতরে রাধাগোবিন্দের যুগল মূর্তি, গৃহস্থের বিশেষ আরাধ্যের। আসলে শুভ্রা’দির বাড়ির গুরুজনেরা এবং ভাই দাদারা অবশেষে বেশ সমাদরেই আমাদের অভ্যত্থনা জানালেন। অপ্রীতিকর কিছু ঘটল না, যেন আমাদের আসাটা এক্সপেক্টেড।
এইবার দেখা গেল পুণ্যশ্লোক’দার খেল। প্রথমত আমরা যে কী কারণে এসেছি সেটাই উত্থাপন করা হল না। বসলাম, জল, মিষ্টি খেলাম। ওনারা হয়তো শুভ্রা’দির কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটাই জানেন, ওরাও সেটা আমাদের মুখ থেকে শোনবার জন্য উদগ্রীব হচ্ছেন, আর পুণ্যশ্লোকদাও ওনাদের হাবভাব ভাব-ভালোবাসা পাতিয়ে বলতে চাইছেন। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই দেখা গেল, ওনাদের কাছে পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্তের নামটা বেশ পরিচিত। পুণ্যশ্লোক’দার কবিতাও ওনারা পড়েছেন এবং উত্তরবঙ্গ সংবাদে পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্তের অনেক লেখাই তাঁরা পড়েছেন। এতএব এটাসেটা নানান গল্প উঠে এলো, পরিচিত নাম, নামের সাহচর্য, উত্তাল দিনগুলো; কিন্তু আসল কথা কেউ উত্থাপন করছেন না। গল্প জমে গেছে, বেশ এখন স্বস্থি লাগছে, এ বাড়িতে ঢোকার আগে কী হবে কী হবে যে অস্থিরতাটা ছিল সেটা যেন এক ‘পুণ্যশ্লোক ম্যাজিকে’ পুরোপুরি উধাও। পুরো পরিবেশটাই যেন গাড়িতে বসেই প্ল্যান করে স্নিগ্ধ করে দিয়েছিলেন এই মহান কবি। আসলে প্ল্যান ভাবলেও আসলে প্ল্য্যান উনি যে করেননি সেটা জানি, মানুষটাই সেরকম ছিলেম, কারুর সঙ্গে বসলে এক লহমায় আপন করে নিতেন। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে পুণ্যশ্লোক’দা এতটাই ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন যে উত্তরবঙ্গের যে কোনও মানুষকেই যেন এক নিমিষে আত্মীয় বানিয়ে দিতে পারলেন তিনি।
এতএব নানা কথার ফাঁকে শুভ্রা’দির জেঠু আসল কথাটা জানার জন্য উশখুস করলেন, বুঝতে পেরে পুণ্যশ্লোক’দাই সবাইকে থামিয়ে যেভাবে গুছিয়ে শুভ্রা’দির বাড়ির লোকেদের বললেন যেন আমাদের কাছে তো বটেই শুভ্রা’দির বাড়ির লোকেদের কাছেও ইভেন স্বয়ং অয়ন’দার কাছেও যেন মনে হল অয়ন’দার এই ছুটে আসাটা কোনও আরব্যরজনীর গল্প’র মতই সত্যি, পুরোটাই যেন রূপকথা, এমন ভাল যে বাসতে পারে তাকেই তো মেয়ে সম্পাদন করা উচিত। নিজের প্রশংসা শুনে অয়ন’দাও যেন গদ্গদ, আর সেই মুহূর্তে আমারও অয়ন’দার প্রতি ভক্তি যেন আরও উপচে উপচে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল, কোনও মতে সামলে নিলুম। সম্মোহনী ক্ষমতা যেন পুণ্যশ্লোক’দার গলায়, আবেগে, আত্মীয়তায়, নিরপেক্ষতায়, বক্তব্যে এবং আশ্বাসে যে ‘ভয় কী রে, আমি তো আছি।’ উনি আছেন এই ভরসাতেই যেন কথা আরও অনেক দূর এগোলো। বিয়ের কথাও বলা হল। এটাও বলা হল শুধু মাত্র ফেসবুকের পরিচয়তেই অয়ন’দার পছন্দ হয়ে যায় এবং একদম না জেনেই সরাসরি এখানে চলে আসা। কয়েকদিন পর ওনারাও দেখতে এলেন, পাকা কথা হয়ে গেল। আর শেষপর্যন্ত সেদিন শুভ্রা’দির জেঠুমণি জানালেন তিনি যদি ভেবেচিন্তে মেয়েকে অয়ন’দার হাতে তুলে দেবার কথা ভাবেন তাহলে মধ্যিখানে পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত আছেন এই ভরসাতেই তুলে দেবেন। এখন ভাবি, ভাগ্যিস বাউণ্ডুলেপনাটা ছিল, তাই শুভম, আমি, প্রীতম, সানু একসঙ্গে মিলে রিষড়ায় বসে উত্তরবঙ্গের রান্নার স্বাদ নিতে পারছি। শুধু আমাদের দুঃখের কথা অয়ন’দার কোনও ছোট শ্যালিকা নেই এই যা ! এই হলেন সদ্য প্রয়াত পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত। মানুষকে ভালোবেসে সব কিছু করে দিতে পারতেন। অয়ন’দা এবং শুভ্রা’দির বিয়ের কথাবার্তা এগোনোর পেছনে সদ্য প্রয়াত পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্তের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পুণ্যশ্লোক’দার মুখেই যা শুনেছিলাম যে আজকের বিখ্যাত কবি সুবোধ সরকার ও তাঁর স্ত্রী প্রয়াতা কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের উত্তরবঙ্গের প্রেমসূচনা ও পরিণতিতেও পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্তের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। পুণ্যশ্লোক’দার মুখেই সেসব শোনা। পরিণত যৌবনে তখন মল্লিকা’দি উত্তরবঙ্গে সম্ভবত শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। সুবোধ’দা তখন মল্লিকাদির টানেই ছুটে যেতেন উত্তরবঙ্গে। অসুবিধা তো হতই। সুবোধ’দার তারুণ্যের ছটায় যে কেউ আকর্ষিত হবেন, তার সঙ্গে তাঁর অসাধারণ লেখনী। পুণ্যশ্লোক’দাও সেই সময় উত্তরবঙ্গে যথেষ্ট নাম করেছেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তখনই বেশ সখ্যতা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গে এলেও পুণ্যশ্লোকদা কবিদের কাছে টেনে নিতেন। পুণ্যশ্লোক’দার পিঠে কাগজ পেতেই একটা গোটা কবিতা লিখে ফেলেছিলেন শক্তি চ্যাটুজ্যে। এই প্রসঙ্গ অন্য জায়গায় লিখব, কিন্তু আসল কথা যেকোনও কবির প্রেম-পরিণতিতে পুণ্যশ্লোক’দার ভূমিকা ছিল সবসময় অভিভাবকের মত। পুণ্যশ্লোক’দা, দূর থেকেই দেখেছেন সুবোধদাকে। নিজে খুব একটা এগিয়ে আসেননি। সুবোধ’দা নিজেও অমায়িক আলাপী মানুষ, নিজেই সেদিন এগিয়ে গেছিলেন, বলেছিলেন, “আমি সুবোধ সরকার, আপনি কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত তো? অল্পক্ষণেই আলাপ জমে গেছিল পশ্চিমবাংলার দুই সেরা কবির। এরপর যতবার সুবোধ’দা উত্তরবঙ্গে এসেছেন, সুবোধ-মল্লিকা স্কোয়ার ততই আরও বৃহত্তর হয়েছে, আর দুই কবিকে সঙ্গে নিয়ে গয়েরকাঁটা থেকে অসংখ্য চা বাগান ছুঁয়ে, উত্তরের সবুজ হাতিচলা পথ স্পর্শ করে ভুটান, নেপাল ছুটে গেছেন কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত, গান শুনেছেন সুবোধ’দা, মল্লিকাদির গলায়। এমনকি ধূপগুড়ির বাড়িতেও সুবোধ’দা পুণ্যশ্লোক’দার মা’কে অপূর্ব উদার্তকণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শুনিয়েছেন। চাঁদের চল্লিশ আয়ু বইটি ক্ষুদ্রাকারে প্রকাশের সঙ্গেও পুণ্যশ্লোক’দার ভূমিকা কিছু ছিল, সেটা অবশ্য আমি খুব বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়নি। ধূপগুড়ি-শিলিগুড়ি অঞ্চলের অনেক কবির প্রেমের পরিণতির ক্ষেত্রেই কবির ভূমিকা নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাঁরা মনে রাখবেন।
পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত যেন ছিলেন উদার প্রকৃতির। সব প্রেমই একাধারে বিকৃত ও সুন্দর, কিন্তু কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত সমস্ত সুন্দরটুকুই নিতেন, অসুন্দরটুকু বিলিয়ে দিতেন উত্তরবঙ্গের প্রকৃতিকে।
আরও দেখুন: রবিবারের ছোটগল্প যুগান্তর মিত্র-এর ‘ঠাকুরদা’