Home / রবিবারের আড্ডা / ছোটগল্প আকাশপ্রদীপ লিখেছেন মেঘমালা দে মহন্ত

ছোটগল্প আকাশপ্রদীপ লিখেছেন মেঘমালা দে মহন্ত

আকাশপ্রদীপ

মে ঘ মা লা দে ম হ ন্ত

আকাশ প্রদীপ

ছবি:প্রীতি দেব

ঘুম আসেনা জটাবুড়ির। এপাশ ওপাশ করে শুধু। আজ সন্ধ্যের পর যখন লাল আলোগুলো জ্বলে উঠলো কর্তার জমির আকাশে বুড়ি বুঝতে পারে এতোদিন ধরে কী তোয়ের করছিলো এতোগুলো মানুষ মিলে।
আকাশপ্রদীপ! ওমন দানবের মতো বড় আকাশদীপ তৈরি করলো কোন ভালো মানুষের সোনার ছেলে। কর্তার এই জমি তো তার কুলাঙ্গার ছেলে বেচে দিয়েছিলো শহরের কোন্‌ বাবুর কাছে। কর্তা চোখ বোজার দু’মাসের মধ্যেই ছেলে সব সম্বল ওই দেড় ছটাক জমি বিক্রী করে বউ আর দুই নাতিকে নিয়ে উঠে গেছে শহরে। এই অজ গ্রামে ফেলে গেছে পরিত্যক্তডোবার ধারে প্রায় ভেঙ্গে পড়া একচালা ছোট্ট ঘর আর জটা বুড়িকে। বুড়ি জানে, সে চোখ বুঁজলেই এই বাড়িও বেচে দেবে ছেলে ।

নিঝুম গ্রামে হেমন্তের সন্ধ্যায় মাটির দাওয়ায় বসে জটা বুড়ি অপলক তাকায় লাল লাল আকাশদীপের দিকে। আকাশপ্রদীপ! এতক্ষণে বুড়ির কাছে স্পষ্ট ছোক্‌রা ঠিকাদারের কথাগুলি। মাঠের মধ্যিখানে এতোদিন ধরে যে এত এত মানুষ মিলে কী বানাচ্ছে তা কত জনকে জিজ্ঞেস করেছে জটা । সবার মুখে এক কথা,

-ও তুমি বুঝবেনা বুড়ি ।

শেষেমেশ একদিন তো জটা ওই কাজের ঠিকাদার ছোক্‌রাটার কাছে চলে গেছিলো টুক্‌টুক করে।

– ও বাবা, কী তোয়ের করো এতদিন ধরে ?

– সিঁড়ি।

-জোরে বল বাবা। কানে শুনতে পাইনা ভালো।

– সিঁড়ি গো সিঁড়ি। সোজা ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি।

– সিঁড়ি! সেকি কথা গো!

ছোক্‌রাটার মিটিমিটি হাসি দেখে বুঝতে পারে বুড়ি, এও গ্রামের লোকেদের মতো তামাসা জুড়েছে। বিড়বিড় করে বুড়ি,

– গায়ে জোয়ানকি আছে, তাই মান্যি-গন্যির বালাই নেই। আসবে বাবা। দিন তোমারও আসবে।

ছোক্‌রাটার এবার মায়া হয়,

– আরে বাবা , তুমি বুঝবে না। ওসব আকাশ হাওয়ায় কারবার।

– কী হবে তাতে?

-দূর দূরের খবর আসবে আকাশ থেকে।

আকাশ থেকে খবর! কেমন যেন চুপ হয়ে যায় জটাবুড়ি। বোকা বোকা লাগে নিজেকে। দিনকাল কত পাল্টালো। কানে ভালো শুনতে পায় না বুড়ি, আর যা শোনে কেমন যেন দুর্বোধ্য লাগে। কিছুই বোধগম্য হয়না ।আকাশ থেকে খবর! কিন্তু খবরটা আসবে কী করে? আর কী-ই বা খবর পাঠাবেন তিনি? ওপারে বসে দেখতে পান্‌না ছেলে কীভাবে থাকে একা এই জলা জঙ্গলে ফেলে চলে গেলো? আগে মাসে মাসে এসে কিছু টাকা দিয়ে যেত, এখন আর নিজে আসেনা। বড় নাতিটাকে পাঠায়। প্রথম প্রথম নাতিটা এলে বুড়ির আহ্লাদ উছলে উঠতো। গ্রামের একে তাকে ধরে এটা ওটা জোগাড় করতো নাতির জন্য। টুকটুক্‌ করে লেগে যেত নানা রান্নায়। কিন্তু এখন আর কোন উৎসাহ নেই ওসবে। সত্যি কথাতো বুড়ি বিরক্তই হয়। শহরের হাওয়ায় পুরো সাহেব বনে গেছে নাতিটা। কথায় কথায় নাক কুঁচকে অভিযোগ,

-এত মশা কেন? সময় কাটাই কী করে? মোবাইল অচল, নেটও নেই…

বুড়ি এতো বোঝেনা। শুধু বোঝে নাতি আর তার নাতি নেই। রাগ ধরে বুড়ির। এতো বাবুয়ানা কিসের রে তোর? গেছিস না হয় শহরে দুদিন হল, কিন্তু বাপ দাদা চোদ্দ পুরুষের জন্ম কম্ম যে এই জলার ধারেই তা ভুলে গেলি কি করে রে হারামজাদা? শহরে গিয়ে তোর বাপ্‌ তো আর জজ মিরাসদার বনে যায়নি। কী বনে গেছে সেটা অবশ্য আজোও জানেনা বুড়ি।

গালাগাল করলে বেশ হাল্‌কা লাগে জটা বুড়ির। তাই যখনই বুকটা হা হা করে বুড়ি একা উঠনের বাঁশ ঝাড়ের নিচে বসে গাল পাড়ে ছেলে, বউ, নাতিদের। মাঝে মাঝে কর্তাও রেহাই পাননা ।

বিছানায় উঠে বসে বুড়ি। পাশের বিছানায় শুয়ে আছে নাতি। বহুদিন পর এবার নাতির মুখে এবার আর বিরক্তির ছায়া দেখতে পায়নি বুড়ি। তার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে কীসব আসার কথা বলেছে, যার এক বর্ণও বুঝতে পারেনি সে।

-ও ঠাক্‌মা, তোমার বাড়িতেও নেট এসে গেলো যে! নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে গো আজ থেকে!

কী এলো আর কী পাওয়া গেলো, না বুঝলেও এটুকু বুঝেছে ওই আসা আর পাওয়ার জন্যই এতো আনন্দ নাতির।সন্ধ্যের পর থেকেই হাতের ছোট্ট যন্তরটা টুকুর টুকুর করেছে এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত। আলো ঝল্‌সে ছবিও তুলেছে বুড়ির ক’টা।

জটা বুড়ির নাতির সত্যি আজ প্রথম এই চারিদিকে পচা ডোবা আর জঙ্গলে ঘেরা বাড়িতে এসে বিরক্ত লাগেনি। ছ’বছর আগেও তার পৃথিবী যে এই বাড়িটি ঘিরেই ছিল তা আজ আর নিজেরই অবিশ্বাস্য লাগে। ভাগ্যিস্‌ বাবা তাদের এখান থেকে নিয়ে শহরে চলে গেছিলো, না হলে সারা জীবন এই ভাঙ্গা বাড়িতে থাকতে হলে… বাপ্‌রে। ভাবতেই ভয় লাগে। আসলে দাদু ঠিক সময় মতো অক্কা পেয়ে রক্ষা করেছে। না হলে যা দাপট ছিলো বুড়োর! যতদিন বেঁচে ছিলো কম জ্বালিয়েছে সবাইকে? দাদুর জন্যই তো, না হলে বাবা আরো কত আগেই জমি বেচে তাদের নিয়ে চলে যেত শহরে। দাদুর ভয়ে বাবা কোনোদিন এসব কথা উচ্চারণ করার সাহসও পায়নি। যাক্‌ বাবা, দেরি করে হলেও সব হয়েছে তো ঠিকঠাক। রিপ রিপ ।দাদু না, এবার তার কাজ ঠাক্‌মাকে নিয়ে। আজকাল নেট-এ গ্রামের ছবি হেব্বি চলছে। আর সঙ্গে এই ঠাক্‌মার মতো মুখে হাজার ভাঁজের চেহারার বুড়ি থাক্‌লে তো কথাই নেই, একশ’টা লাইক সিওর। সকাল থেকে বেশ কিছু ছবি তোলা হয়ে গেছে।

কার্তিক মাস চলছে। অত উচুঁতে কি করে জ্বলল আকাশবাতিটা? তিল তেলের প্রদীপতো! এতো ভক্তি পিত্তিপুরুষে!ধন্যি তার মা বাপেরা। আরে, আজ তো কার্তিকের শেষ রাত। আজকাল সব ভুলে যায় বুড়ি।ইস্‌ আগে যদি জানতো মাঠে ওটা আকাশদীপের কপিকল হচ্ছে তাহলে আজ নাতিটার হাতে একটা বাতি জটাও তুলে দিত কর্তার জন্য।

ঘুম আসেনা আর জটার। ঠান্ডা পড়েছে বেশ জাঁকিয়ে। পিঠে ঠান্ডা লাগছে। কাশির দমক ওঠে, কিন্তু শুতে ইচ্ছে হয়না আর। মুচকী হাসে জটা।

-কী কর্তা, চাই নাকি একটা তিল প্রদীপ? খুবতো বলতে আকাশদীপ নাকি আয়েসি লোকের কারবার। গরীব মানুষ মরে গেলেই সব শেষ। ওপারে গিয়েও পেটের ধান্দায় ঘুরতে হয়। বাতি দেখার সময় ওখানেও নেই। আজ দেখো জটা তোমায় কেমন আলো দেখায়।

গায়ে কম্বলটা জড়িয়ে জটা বারান্দায় আসে। নিবে যায়নি তো! না, সন্ধে থেকে একই ভাবে জ্বলছে। শুধু কুয়াশার জন্য একটু তেজ কম মনে হচ্ছে। নাতিটা বলছিল, এ বাতি নাকি এখন থেকে বছরভর জ্বলবে। কার্তিক মাস পেরিয়ে গেলেও। তারমানে জটাও ওই আলোতেই পৌঁছে যাবে কর্তার কাছে। কিন্তু কর্তার জমিতে কার্তিক মাসে আকাশদীপ জ্বলবে আর একটা বাতি পাবেনা কর্তা! ছেলে না হয় কুলাঙ্গার কিন্তু জটাতো মরে যায়নি আজো।

উঠোনের তুলসী তলা থেকে প্রদীপটা হাতে নিয়ে ঘরে আসে জটা। শনি ঠাকুরের জন্য তুলে রাখা তিল তেলের বোতল থেকে প্রদীপ ভরে তেল ঢালে।তারপর জ্বলন্ত প্রদীপ হাতে আবার উঠোনে নামে। পুকুরপাড়ের আমগাছ থেকে পুকুরের জলে শিশির পড়ছে টুপটুপ আওয়াজ করে।সাদা কুয়াশায় আকাশদীপের আলোও ঝাপসা। ইদানীং চোখে ভালো দেখতে পায়না জটা। গায়ে কম্বলটা জড়ানো আছে কিন্তু মাথাটায় যেন লক্ষ সূঁচ ফোটাচ্ছে ঠান্ডা।কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চলে বুড়ি টলোমলো পায়ে। জ্বলন্ত প্রদীপটা যদি নিবে যায় সে ভয়ে একটা দেশলাইও গুঁজে নিয়েছে ট্যাঁকে। আবছা কুয়াশা মাখা জ্যোৎস্নায় এবড়ো খেবড়ো পথে সাবধানে এগিয়ে চলে বুড়ি। কার্তিকের রাত শেষ হবার আগেই প্রদীপটা ওইখানে তুলে দিতে হবে। কিন্তু কপিকলটা কি এই অন্ধকারে কি খুঁজে পাবে জটা? পৌঁছুতে পারলেই হয় এখন। গোটা শরীর যেভাবে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে তাতে এগোনো অসম্ভব হচ্ছে ক্রমশ। চলতে চলতে কান্না পায় জটা বুড়ির। এই জমি এক সময়ে তাদের ছিল, কর্তা মারা যেতেই ছেলে সব পর করে দিলো। আজ জটার জমিতে কেমন জ্বল্‌জ্বল্‌ করে জ্বল্‌ছে কে জানে কার আকাশবাতি। হিংসে হয় জটার।অথচ গত জলবিষু থেকেই জটা কেমন যেন ছট্‌ফট্‌ করছে। শরীরের গতিক যে তেমন তালের নয় সেকি আর সে বোঝেনা! পুরো শ্রাবণ মাসে একটা দিন পারেনি প্রাণভরে পদ্মপুরাণ পড়তে। পড়া শুরু করলেই কাশির দমকে প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম। সবই এক এক করে শেষ হয়ে আসছে। এবার জটার পালা।

ঠান্ডায় বুকে চিন্‌চিন্‌ ব্যাথা হচ্ছে যেন। পৌঁছে যায় জটা দূর থেকে দেখা লাল আলোর নীচে। একটা খুঁটির আড়ালে প্রদীপটা রাখতে গিয়ে আর সোজা হতে পারেনা, বসে পড়ে মাটিতে। হাতড়ে হাতড়ে ঠাওর করতে চায় কোথায় কপিকলের দড়িটা।দড়ি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত জটার ঠান্ডা কেটে এবার যেন একটু গরম লাগে। খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পা ছড়িয়ে দেয় জটা। বুকের চিন্‌চিন্‌ ব্যাথাটা এবার যেন খামচে ধরছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে কপালে। জটা বুঝতে পারে এই দানব আকাশদীপের আলোয় কর্তা নেমে এসেছেন তার জমিতে। জটাও আজ সঙ্গী হবে তাঁর। হাত দুটো অবশ লাগে। বহু কষ্টে বাঁ হাত বাড়িয়ে তেল ভর্তি প্রদীপটা হাতে নিতে চেষ্টা করে জটা ।

পাশের বাড়ির পরাণ দাদার চীৎকারে ঘুম ভাঙ্গে জটার নাতির ।

-ও দাদা, শিগ্‌গীর ওঠো। তোমার ঠাক্‌মা যে মাঠে বসে বসে মরে আছে…

ঠাক্‌মা বসে বসে মরে আছে! খালি বিছানাটার দিকে তাকায়। কিছু বোধগম্য হয়না, তবে ঠাক্‌মা মরে গেছে এটুকু বুঝতে পেরে দৌড়ে উঠোনে নেমে আসে।চটিটা পায়ে গলিয়ে আবার ছুটে যায় ঘরের ভেতর। মোবাইলটা পকেটে পুরে নেয়। ঠাক্‌মা সিরিজের শেষ ছবিগুলো মিস করলে হবেনা। মাঠে মোবাইল টাওয়ারের নিচে গ্রামের লোক ভিড় জমিয়েছে। দিনের আলোয় আকাশ প্রদীপ উধাও। টাওয়ারের খুঁটির গায়ে হেলান দেয়া জটার শরীর ঠান্ডায় শক্ত হয়ে আছে। বাড়ানো বাঁ হাতের পাশে পড়ে আছে নিভে যাওয়া প্রদীপটা। জটার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম কখন মুছে দিয়েছে টিপ্‌টিপ্‌ কুয়াশা। মোছেনি শুধু ঠোঁটের হাল্‌কা হাসির রেশটুকু। ঠাক্‌মা সিরিজের শেষ ছবিগুলো মোবাইলে বন্দি হতে থাকে ক্লিক্‌ ক্লিক্‌ করে।

আরও পড়ুন: রবিবারের গল্প পূজা মৈত্রের ছায়ালাপ

Check Also

গল্প

রবিবারের ছোটগল্প চাঁদ ছোঁয়ার গল্প লিখেছেন সাগরিকা রায়

ছোটগল্প Illustration: Preety Deb কচু গাছের আড়ালে দাঁড়ালেও চান্দু নিজেকে বেশ লুকোতে পারে।গজু বলে, ভাই …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *