ধারাবাহিক উপন্যাস
খাতা
দেবশ্রী চক্রবর্তী
Illustration: Preety Deb
তিতিরের মনে হল সে বহুক্ষণ এখানে থেকেও উধাও হয়ে গেছিল, তাই পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ থাকলেও সে কোন কিছু অনুভব করে উঠতে পারেনি। খুব ঝড় হচ্ছে, মাধবীলতার ঝাড়টা ঝোড়ো হাওয়ায় খুব জোরে জোরে দুলছে। ঝড় শুরু হওয়ার আগে পাখিরা ছোটাছুটি করে, কিন্তু এই অঞ্চলে চারপাশে ঘণ গাছপালা থাকলেও তিতির কোন দিন কোন পাখির ডাক শোনেনি। চিকোনের পর্দার নিচে যে ঘুঙ্গুরগুলো লাগানো আছে তাতে ঝম ঝম আওয়াজ হচ্ছে, দরজার ভেতরে কিছু দেখা যাচ্ছেনা, ঘরে আলো জ্বালানো হয় নি। এ বাড়িতে টিয়া নামের একটি কাজের মেয়ে আছে, টিয়া তার বাবা বলরামের সাথে এবাড়ির নিচতলার ঘরে থাকে। বলরাম প্রায় তিরিশ বছর এ বাড়িতে থাকে। বলরামের মতন তার বাবা বাসুদেব এই বাড়ির দারোয়ান ছিল, বাবার মৃত্যুর পর ছেলে দারোয়ান হয়েছে। টিয়ার মাকে তিতির কোন দিন দ্যাখেনি। তিতিরের মনে হয় টিয়ার মা নেই। মেয়েটার সাথে খোলা মনে কথাও বলা যায় না, তার মনে হয় মেয়েটা যেন তাকে ভয় পায়। কোন কিছু বলার থাকলে দূর থেকে বলে, আর যখন সে কথা বলে তার গলা কাপে, কপালে ঘাম হয়। তিতির যখন নিজের ঘরে থাকে মেয়েটা তখন বাইরের সব কাজ সেরে নেয়। তিতিরের অনুপস্থিতিতে সে তিতিরের ঘরে কাজ করতে আসে।
আজ মেয়েটা এখনো ওপরে আসে নি, হয় তো চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে বলে ভয়ে আসছে না। তিতিরের ঘরের ভেতর যেতে ইচ্ছে করছে না। কীর্তনখোলা নদীর ওপর ঘন মেঘ জমেছে, নদীর মাঝখানে এখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেবীপুরে বৃষ্টি শুরু হবে। জামসেদপুরের মেয়ে তিতিরের কোন দিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় নি, জীবনের সব কিছু ভালোলাগার স্বাদ সে নিতে চায়, তাই হয় তো আজ বৃষ্টিতে ভেজার অপেক্ষায় সে আছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও বৃষতি কিছুতেই এগিয়ে আসছে না তাদের বাড়ির দিকে, পাখির ডাক, বৃষ্টি সব কিছুর থেকে যেন এ অঞ্চল বঞ্চিত। এখানে আসার পর কোন ফুলের গাছও তার চোখে পরেনি। তাহলে কি এখানে কোন ফুলও ফোটে না। অনেকক্ষণ নদীর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকার সময় তিতির মন্দিরের ঘন্টার আওয়াজ পেল। ঝোড়ো হাওয়ায় খুব জোরে জোরে ঘন্টাগুলো বাজছে।রানাদের কুলদেবতা বিশ্বেশ্বরের মন্দির থেকে মনে হয় এই আওয়াজ আসছে, ওদের এখানে আসার পর এত দিন কেটে গেছে, কিন্তু রানা কোন দিন তাকে সেই মন্দিরে নিয়ে যায়নি, নতুন বৌ প্রথম বাড়িতে এলে তাকে আগে কুলদেবতার দর্শন করাতে নিয়ে যায় সবাই, কিন্তু এ বাড়িতে রানা ছাড়া আর তো কেউ নেই যে তাকে নিয়ে যাবে। আর সে তো গ্রামে তার মায়ের নামে একটা মানসিক হাসপাতাল তৈরির কাজে সারা দিন ব্যস্ত। তিতিরের মনে হল সাদা চিকোন পর্দার ভেতর দিয়ে একটা মৃদু আলো সে দেখতে পাচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যে ছোট্ট একটা আলো। তিতির পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তার পেছনে পর্দাটা ঝম করে একটা শব্দ তুলল। ক্ষনিকের জন্য একটু চমকে গেছিল সে। কিন্তু একটু গা ছমছম পরিবেশ না হলেও যেন ঠিক জমে না। কথাগুলো মনে মনে ভেবে তিতিরের খুব মজা লাগলো, তার মতন ভাগ্যবান মানুষ হাতে গুনে কয়েকজনই হয়, যারা এরকম পরিবেশে থাকার সুযোগ পায়। বসার ঘর থেকে বেরিয়ে শুরু হয় লম্বা বারান্দা, বারান্দার শেষ প্রান্তে জ্বলছে আলো। একটা খস খস শব্দ সে শুনতে পেলো, খুব দ্রুত শব্দ হচ্ছে, তিতিরের মনে হল এখন ওখানে যাওয়াটা ঠিক হবে না, আর কিছুক্ষণ বরং এসব কিছুর মধ্যে থাকা যাক, তারপর না হয় গিয়ে দেখা যাবে, তিতির মনে মনে হাসলো আর বলল, গেলেই তো সব শেষ আর কি। সে বারান্দার এক কোনে বসে পড়ল, তিতির দেওয়ালে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে তার মাথার ওপরের ঝাড়বাতিটার দিকে, বাইরে এত হাওয়া, সেই হাওয়া বারান্দায় এলেও ঝারবাতি দুলছে না। এই লম্বা বারান্দায় গোটা দশেক ঝাড়বাতি তো আছেই, কিন্তু তারা যেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে কোনদিন তারা দুলবে না। এই বাড়ির গঠনটা অন্য জমিদার বাড়ি থেকে একেবারে আলাদা। কিরকম যেন একটা গোলোক ধাঁধার মতন, বাড়ির কোন একটা নির্দিষ্ট দিককে কোন একটি দিক থেকে ঠিকঠাক দেখা যায় না। সে এবার উঠে দাঁড়াল, তার মনে হচ্ছে পশ্চিমের বন্ধ দরজার ভেতর থেকে আলো আসছে, সে কিছুটা গিয়ে দেখল আজও দরজা বন্ধ, কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে আলো বের হচ্ছে। এই দরজাটা সব সময় বন্ধ থাকে, সে বহুবার খোলার চেষ্টা করেও পারেনি। কিন্তু আজ একটা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেলো। ঘরের ভেতরে তিতির যা দেখল তা যদি সত্যি হয় তাহলে নয় তিতিরের মানসিক কোন সমস্যা আছে আর তা যদি না হয় তাহলে এই বাড়ির ভেতরে কোন সমস্যা আছে যা খালি চোখে ধরা যাচ্ছে না। ঘরের ভেতরে ঢুকে সে দেখল টিয়া মেঝের ওপর বসে ছবি আঁকছে, ছবিতে কোন রঙ নেই, স্কেচ করা হচ্ছে, মেয়েটি খুব দ্রুত স্কেচ করে চলেছে তাই দূর থেকে কিছু একটা ঘসার শব্দ সে পেয়েছে। টিয়া ছোট মেয়ে , সে ছবি এঁকেছে, তাতে কোন অস্বাভাবিক কিছু হয়নি, কিন্তু যা অস্বাভাবিক তাহচ্ছে, যে টিয়া তিতিরকে দেখলে ভয় পায়, তার কাছে আসার সাহস টুকুও তার মধ্যে নেই, সেই টিয়া তিতিরকে ঘরে ঢুকতে দেখে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মামনি, আজ আমি দুটো ছবি একেছি, তুমি দেখবে?” আরেকটা অস্বাভাবিক ব্যাপার হচ্ছে এই ঘরের পরিবেশ, এই ঘরে ঢোকার আগে সময়টা ছিল বিকেল বেলা, সে আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখেছে, চারিদিক অন্ধকার করে এসেছিল। কিন্তু এই ঘরে ঢুকে মনে হল যেন সবে সকাল হয়েছে, চারদিক আলোয় ঝলমল করছে, এই প্রথম সে এই বাড়ির জানালায় এক চড়ুই পাখিকে দেখতে পেল, বাইরে থেকে পাখির ডাক আর আলো এসে ঝলমল করছে এই ঘর। তিতির টিয়ার মাথার মাঝখানে চুমু খেয়ে বলল, “তুমি কি বলে ডাকলে আমাকে ? আরেকবার ডাকো।” তিতির বলল, “কেন, তুমি জানো না, তুমি তো আমার মামনি হও।’’ এই প্রথম তিতির নিজের মধ্যে মাতৃত্ব অনুভব করলো। সে প্রথম টিয়াকে খুব কাছ থেকে দেখলো, তাকে ছুয়ে অনুভব করল। টিয়াকে দেখে কোনভাবেই মনে হয় না এ বাড়ির কাজের মেয়ে। তার শরীরের ঘঠন, কথা বলার ভঙ্গিমা দেখলে তাকে মনে হয় কোন সম্ভ্রান্ত বংশীয়া। মনে একবার খটকা লাগলো, সে যাকে দেখছে সে টিয়া তো ? কিন্তু টিয়া ছাড়া আর কারুর তো আসা সম্ভবও না এই বাড়ির ভেতরে। মেয়েটিকে যতবার সে দেখেছে দূর থেকে দেখেছে, তাছাড়া এ বাড়ির অন্য ঘরগুলো দিনের বেলায়ও এত অন্ধকার থাকে যে সামনা সামনি কেউ দাড়িয়ে থাকলেও তার মুখ ঠিকঠাক দেখা যায় না। তিতির টিয়াকে বলল, টিয়া তুমি কি কি ছবি এঁকেছ, আমাকে দেখাও। টিয়া মেঝের ওপর বসে মেঝের ওপর জোরে জোরে আওয়াজ করে তিতিরকে বলল, “বসো, আমার পাশে এসে বসে আগে আমাকে আদর করো, তারপর আমি তোমাকে সব ছবি দেখাবো।’’ তিতিরের মনে হল এই মেয়েটির সাথে ওর বহুদিনের কোন গভীর সম্পর্ক আছে, যা সে এই মুহূর্তে মনে করতে পারছে না। মনে করার দরকারও নেই, কারন যে কোন সম্পর্ককে নতুন করে আবিষ্কার করতে তিতিরের ভালো লাগে, এতে সম্পর্ক গুলো পুরনো হয় না। সে টিয়ার পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে টিয়ার কপালে, গালে সব জায়গায় চুমু খেলো। টিয়ার চোখ দুটো খুব বড়, ঘন কালো চোখের পাতা টিয়ার চোখকে অন্য একটা মাত্রা দিয়েছে। সে সদ্যজাত শিশুর মতন তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে। আদরকরা শেষ হলে টিয়া তার আকা ছবি দেখায়, ছবিতে একটা মন্দির, মন্দিরটা বেশ সুন্দর, তার চারপাশে বাগানে ফুল ফুটে আছে কিন্তু টিয়া ফুলে কিংবা মন্দিরে কোন রঙ করেনি। আরেকটা ছবিতে একটা জানালা, জানালা দিয়ে মন্দির আর তার বাগান দেখা যাচ্ছে। ছবির জানালাটা এই ঘরের জানালার মতন দেখতে। জানালা গুলো মেঝে পর্যন্ত, এই বাড়ির সব কটা জানালা এক হলেও এই ঘরের জানালার মধ্যে দুটো রড নেই। আর বাকি রড গুলো একটু বাকা। ছবির জানালাটাও অবিকল এক রকম, জানালার রড গুলো যে জায়গায় যেমন বাকা, ছবিতেও ঠিক এক ভাবে আকা হয়েছে। ছবিটা ভালো করে দেখলে মনে হবে যেন ছবিটা জানালার জেরক্স কপি। তিতির উঠে গিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাড়াল, এই খান থেকে একটা সাদা রঙের মন্দির দেখা যাচ্ছে, মন্দিরের সামনে অনেকটা জায়গা নিয়ে বাগান, বাগানে নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। মন্দিরের ডানদিকে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে, পুরো গাছটা ফুলের ভারে কেমন যেন কমলা হয়ে আছে। তিতির মনে মনে ভাবছে, সামনে শিবরাত্রির পূজা আছে, সেই দিন মন্দিরে গিয়ে সে মহাদেবকে পূজো দেবে। টিয়া খিলখিল করে হেসে ফেললে, তিতির একটু চমকে গেলো, সে বলল, “কি রে হাসছিস কেন ?” “তুমি ঠিকই ধরেছ এটা মহাদেবের মন্দির। গতবছর বিশ্বশ্বরের মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, আগে তো এ গ্রামে কোন মন্দির ছিল না, পাশের গ্রাম পলাশপুরের শিব মন্দিরে সবাই পায়ে হেটে পূজা দিতে যেতো। গ্রামবাসীর যাতে সুবিধা হয়, তাই তো বড় ঠাকুর এই মন্দির তৈরি করলেন।” তিতিরের মনে হল মেয়েটা মনের কথা বুঝতে পারে । টিয়া বলল, “সে একটু একটু বুঝতে পারি বৈকি ।’’ তিতির মনে মনে ভাবলো, সে কোন একটা বইতে পড়েছে যাদের মনযোগ খুব বেশি থাকে, তারা মানুষের মনের কথা পড়তে পারে। এই মেয়ের সেরকম কোন ক্ষমতা নিশ্চই আছে। তাই এর সামনে আর কিছু ভাবা ঠিক হবে না। টিয়া দরজার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ঐ দ্যাখো, তোমাকে তোমার বর ডাকছে, তুমি এখন এসো বুঝেছ?”
মেয়েটার মুখে সবসময় একটা মায়া মাখা হাসি থাকে, সে কত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে । এ বয়সী কোন মেয়ের কাছে এসব আশা করাই যায় না। তিতির বলল, “পাকা বুড়ি একটা, কোথায় আমাকে ডাকছে?” মেয়ের মুখের হাসির সাথে চোখ দুটো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সে বলল, “দরজাটা বন্ধ তো, তাই বুঝতে পারছো না তুমি।” তিতির দেখল দরজায় খিল দেওয়া, কিন্তু সে তো দরজা বন্ধ করে নি, তবে? তিতির উঠে দরজাটা খুলতেই অন্ধকার বারান্দার ওপর পাশের ঘর থেকে আসা লন্ঠনের আলো দেখতে পেলো। সে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে ঘরের দরজা বন্ধ। দু’তিনবার ধাক্কা দিয়েও সেই দরজা আর খুললো না অথচ দরজায় বাইরে থেকে কোন তালা ঝোলানো নেই। তাহলে সে এতক্ষন কার সাথে কথা বলছিল! তিতিরের খুব ভয় করছে, সারা গা দিয়ে তার ঘাম ঝড়ছে, সে তাড়াতাড়ি হাটতে লাগল, সামনে সিড়ির ধারে টিয়া দাড়িয়ে আছে।
তিতির চীতকার করে বলল, “টিয়া, তুই এখানে কি করছিস? তিতিরের মনে হল টিয়ার সারা শরীর ভয়ে কাপছে, সে পাশের টেবিলের ওপর হ্যারিকেন রেখে কাপা গলায় বলল, “মামি ভুল হয়ে গেছে, আর আসবো না, আমাকে মাফ করেন।” তিতির এই টিয়াকে তার দেখা সেই টিয়ার সাথে কিছুতেই মেলাতে পারছে না। আগের টিয়া তাকে মামনি বলে ডাকছিল, এই টিয়া তাকে মামি বলে ডাকছে।“কিরে টিয়া কাছে আয়, আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে তোর?” টিয়া মনে হল দু’পা পেছনে সরে গেলো।পেছন দিকটা খুব অন্ধকার, সিঁড়ি তে ধুপধাপ শব্দ হল, টিয়া ভয়ে নিচে চলে যেতেই টেবিলের লন্ঠনের আলোটা নিভে গেলো। লন্ঠনে তেল না থাকার কোন কারন নেই, বাইরের হাওয়াও এখানে এসে পৌঁছচ্ছে না, তাহলে ! তিতিরের খুব ভয় করছে। তার মনে হল খসখস করে আবার সেই শব্দটা আসছে কানে। সারা শরীর ভয়ে কাপছে তার, মনে হচ্ছে গলা বন্ধ হয়ে আসবে এবার। নদীর বুকে যেন বাজ পড়ল, সেই নীল আলোয় প্রাসাদের ভেতরটা ভয়ঙ্কর এক রূপ ধারণ করল, তারপর চারদিক অন্ধকার, এখানে আর এক মূহুর্ত তার থাকা ঠিক হবে না। তিতির সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসল নীচে, বারান্দায় এসে সে টিয়াকে দেখতে পেলো, টিয়া ভয়ে গুঙ্গিয়ে উঠে ঢুকে গেলো তার ঘরে। তিতির বাগানে এসে দ্যাখে বাইরের গেট বন্ধ। সে বলরামের নাম ধরে বেশ কয়েকবার ডাকার পর বলরাম ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে আসে। বলরামের মুখ অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না, শুধু অবয়ব দেখে বোঝা যায় সে একজন পুরুষ। তিতির বলে, “ বলরাম , দরজা খুলে দাও। আমি একটু বাইরে যাবো।” কিছুক্ষন সব চুপচাপ। তারপর বলরাম বলে, “ছোট ঠাকুরের নিষেধ আছে, আপনি ওপরে যান।” তিতিরের খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে, অন্ধকারে তাকে কোন এক তান্ত্রিক দেবীর মতন দেখাচ্ছে। সে অসহায়ের মতন বলে, “আমি তো বলছি, দরজা খুলে দাও।” বলরাম কিছুক্ষন চুপ করে দাড়িয়ে ভেতরে চলে গেলো। তিতির চারদিকে তাকিয়ে দেখল বড় বড় গাছ গুলোকে অন্ধকারে দৈত্যের মতন দেখাচ্ছে, গাড়ি বারান্দার এক কোনে মাধবী লতাটা দুলতে দুলতে হঠাত স্থির হয়ে গেলো, চারদিক চুপচাপ, কোনো সাড়াশব্দ নেই। সবাই যেন তাকে লক্ষ্য করছে। বাইরে কোথাও বৃষ্টি হলেও এই বাড়ির ভেতর হচ্ছে না, এতক্ষন হাওয়ায় গাছে পাতা নড়ছিল, এখন সব নিস্তব্ধ। সময় যেন থমকে গেছে। তিতিরের খুব কান্না পেলো, মনে হচ্ছে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন অন্ধকারে দাড়িয়ে থাকার পর তিতির অনুভব করল তার চুল গুলো আবার উড়তে থাকল। সে যেখানে দাড়িয়ে আছে তার ঠিক ডানদিকে মাধবীলতার গাছটা খুব জোরে জোরে দুলতে লাগল, সেই সাথে বাগানের গাছের পাতার আওয়াজ সে পেলো। এরকম কয়েক সেকেন্ড চলার পর আবার সব স্তব্ধ হয়ে গেলো। এরকম কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ থাকার পর এবার যেন সাইক্লোন শুরু হল বাগানের ভেতরে।তিতির সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির ওপরে উঠে আসছে , সে খুব জোড়ে দৌড়েছে বলে কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে হাফাতে থাকল। সে চোখবন্ধ করে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে পেলো। “রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে
তোমার আমার দেখা হল সেই মোহনার ধারে।” তিতির চোখ খুলে দ্যাখে সারা বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে। গানটা সেই বন্ধ ঘরটার দিক থেকে আসছে। তিতির ধিরে ধিরে সম্মোহনের মধ্যে দিয়ে যেন এগিয়ে গেলো সে দিকে। দরজার সামনে পৌছতেই গানটা বন্ধ হয়ে গেলো। দরজার নিচ থেকে আলো বেরচ্ছে, সে দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেলো, আলোয় ঝলমল করছে সে ঘর। খাটের মধ্যে দুই ভদ্রমহিলা বসে গল্প করছেন, দুজনের পড়নে হাল্কা সবুজ রঙের মসলিন শাড়ি, দুজনের নাকে নথ আর সারা শরীরে ভাড়ি গয়না। তিতিরের দৃষ্টি গেলো মানতাসার দিকে, দুজনে এক ডিজাইনের মানতাসা পড়েছে। একজন জাতা দিয়ে সুপারি কাটছে আরেকজন পানের ডাবর থেকে মশলা বার করে মুখে পুরলেন । তিতিরকে ঘরে ঢুকতে দেখে দুজনেই হাসি মুখে সেই দিকে তাকালেন, যিনি সুপারি কাটছিলেন তিনি বললেন আয় মামনি, তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তিতির ওদের দিক থেকে মুখ সরিয়ে জানালার দিকে গেলো, বাইরে থেকে নানা রকমের আওয়াজ আসছে। যেন কোন উৎসব হচ্ছে। তিতির জানালার দিকে তাকিয়ে দ্যাখে জানালার রড গুলো সব কে ঠিক করে দিয়েছে, সে সেই রড ধরে তাকালো বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের দিকে। মন্দির প্রাঙ্গনে মেলা বসেছে।সে মন দিয়ে গ্রামের মেলা দেখছে, কত রকম দোকান, দোকানিরা নানা রকম জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে।এমন সময় ঘরের ভেতরে গ্রামাফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। তাতে গান হচ্ছে “সেইখানেতে সাদায় কালোয় মিলে গেছে আধার আলোয়,
সেইখানেতে ঢেউ উঠেছে এ পারে ওই পারে।” তিতির পেছন ফিরে তাকিয়ে দ্যাখে টিয়া খাটে বসে পা দোলাচ্ছে, দুই ভদ্রমহিলা সেখানে আর নেই, টিয়া তিতিরের তিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে, “কি গো মিলে গেলো তো এপারে আর ওপারে? হ্যা?” মেয়েটার হাসির মধ্যে ভয়ঙ্কর একটা ধার আছে, সেই ধারটা তিতিরের বুকের ভেতরটা যেন চিড়ে দিলো। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো আবার, কিন্তু গ্রামাফোনের গানটা চলতে চলতে আওয়াজ গুলো কেমন জড়িয়ে অন্য রকম শব্দ বের হতে লাগল। এ যেন এক পুরুষের গলার শব্দ, সে শিব স্তোত্র উচ্চারন করে চলেছে, মন্দিরে শিঙ্গা বেজে উঠল, সেই সঙ্গে উলু ধ্বনী। মন্ত্রের ধ্বনী যত তীব্র হল সেই সঙ্গে উলুধ্বনী আর সিঙার শব্দ যেন চারদেওয়ালে প্রতিধ্বনীত হতে লাগল, সে এখন মন্দিরের গর্ভগৃহে দাড়িয়ে আছে, চারিদিকে ঘন অন্ধকার। সে শুধু শিব লিঙ্গ দেখতে পাচ্ছে। তিতির জ্ঞান হারালো।
Read More: ধারাবাহিক উপন্যাস খাতা লিখেছেন দেবশ্রী চক্রবর্তী : পর্ব-৩