নিখিলের মৃত্যু
নি শো আ ল মা মু ন
Illustration:Preety Deb
নিখিল এম.এ পাশ করে বসে আছে।
অনেক জায়গা ঘুরেও কোন চাকরি পাচ্ছে না। প্রায় তিন বছর ধরে বহু পুরাতন একটা বিল্ডিং এ মেস করে থাকে, তাই বের করে দিচ্ছে না। কিন্তু মেসের ম্যানেজার তাগাদার উপর তাগাদা দিয়ে অস্থির করে তুলেছে। মেসের অন্য সব সদস্যরা যখন ধুমধাম করে। পোলাও-মাংস খেয়ে টেবিল বাজিয়ে গান করে তখন নিখিল ম্যানেজারের তাগাদা খেয়ে ঢাকার বিভিন্ন গলিতে হেঁটে বেড়ায়। একদিন অনেক কষ্টে তার এক ছেলেবেলার বন্ধুর সাথে দেখা করে চাকরি যোগাড় করল। প্রথম কাজ আরম্ভ করেই রাজেন্দ্রপুর গ্রামে যেতে হয়। গ্রামটি অতি দরিদ্র। তবে ছবির মত দেখতে। মনির সাহেব এই গ্রাম একটি বাগানবাড়ি করবেন বলে তার দেখাশুনার দায়িত্ব নিখিলকে বিশ্বস্ত মনে করে ছেড়ে দিলেন। নিখিল ময়মনসিংহের ছেলে। সে বেড়ে উঠেছে শহরের পরিবেশে। নাটক, সিনেমা, লেকের পাড়ে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডায় কেটেছে তার প্রায় সময়। কিন্তু এই নির্জন গ্রামে তার সময় কিভাবে কাটবে তা হলো বড় সমস্যা। জঙ্গলের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বিঘা জমি পরিষ্কার করে সেখানে রির্সোটের কাজ চলছে। জঙ্গলের ভিতরে কাঠের এক ছোট ঘরের মধ্যে তার অফিস এবং পাশের রুমটাতে থাকার জায়গা। তার ঘরের সামান্য একটু দূরে বড় একটি পুকুর। তার চারপাশে জঙ্গল। হাজার জোনাকীর আলো জ্বলে-নিভে। বাগানবাড়ির মধ্যে যে সকল লোকজন কাজ করে তারা খুবই বর্বর। শিক্ষিত একজন ছেলের সাথে কিভাবে মিশতে হয় তার সামান্য জ্ঞানটুকু নেই। না বোঝে তারা নিখিলের কথা, না নিখিল বুঝে তাদের কথা। অল্প কিছু হিসেব-নিকেশ ও কর্মচারীদের সামান্য কাজ বুঝিয়ে দেওয়া ছাড়া আর তেমন কাজ নেই। যে কয়েকটি বই সাথে করে নিয়ে এসেছে, সে সব বই পড়ে বাকি সময়টা কাটে। দূরের নির্জন ঘন-গাছপালা, পাখির কিচির-মিচির শব্দে পূর্বাকাশে সূর্যোদয় হয়। দুপুর বেলায় যখন খা খা করে তখন অতি দূর থেকে ভেসে আসে অচেনা পাখির গান। জঙ্গলের মাথায় মাথায় সূর্য্য সিঁদুর ছড়িয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়। সন্ধ্যায় শিয়ালের হূক্কা-হূয়া ডাক। যেন এক বিচিত্র পরিবেশ। নিখিল কখনো কখনো চমকে উঠে। আবার কখনো তার বুকের মধ্যে চৈত্রের এক দীর্ঘ বাতাস বয়। এই অরণ্য ভূমি, নির্জনতরে মধ্যে কি করে একটি মাস কাটল! নিখিল সম্পর্কে একটা কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাদের নিখিল স্কুল জীবন থেকে গল্প, কবিতা, গান, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস দিস্তায় দিস্তায় লিখে ফেলেছে। দু’একজন বন্ধু ছাড়া আর কাউকে দেখায় নি। এম.এ পাশ করার পর যখন হদ্য বেকার তখন কয়েকবার প্রকাশকদের কাছে গিয়েছিল । কিন্তু প্রকাশকরা শুধু আশা দিয়ে যাচ্ছিল, আজ না কাল বলে । লজ্জাবতীর সবুজ পাতা যেমন হঠাৎ মিলে যায় তেমনি নিখিলের লেখার ইচ্ছাও হারিয়ে ফেলল। এক রাতের কথা। সেদিন দোল পূর্ণিমা। গাছে গাছে ফুল ফুটেছে। যে জোছনা রাতের কোন বর্ণনা নেই। এমন জোছনা রাত শুধু নিজের চোখেই দেখতে হয়। সে জোছনা রাতে নিখিলের কবি হৃদয় হঠাৎ আবার জেগে উঠলো। সন্ধ্যার পরে যখন জঙ্গলে হুতুম ডাকে এবং গ্রামের কামলা-কিষাণরা ঘুমিয়ে যায়, যুবক ছেলের দলরা গলা ছেড়ে গান ধরে তখন নিখিল জানালার পাশে বসে দু’একটা গল্প, কবিতা লিখে। নিখিলের বেতন খুব সামান্য। নিজেকে রান্না করে খেতে হয়। মাঝে মধ্যে গ্রামের পিতামাতাহীন এগারো- বারো বছরের একটি ছেলে তার কাজ-কর্ম করে দেয়। ছেলেটির নাম রাসেল। গ্রামের কেউ তাকে দেখতে পারে না। বিরাট চোর নামে তার একটা বদনাম আছে। যা-ই দেখে তুলে নিয়ে যায়। গ্রামের সবাই বলা-বলি করে সে নাকি খুবই ভয়ংকর। তার কারণেই তার মা-বাবা কে মরতে হয়েছে। এই অল্প দিনের মধ্যে সে খুব নিখিলের ভক্তও হয়ে গেছে। ঘুঘু ডাকা শ্রান্ত দুপুরে নিখিল যখন লেখালেখি করে তখন রাসেল জানালার ওপাশ থেকে গভীর কৌতূহলে দেখে। চোখে চোখ পড়লেই পালিয়ে যায়। রাতে যখন গভীর অন্ধকার হয়, হারিকেনের আলো জ্বেলে নিখিল জানালার পাশে লিখতে বসে। জানালার ওপাশে খুট করে শব্দ করে বড় বড় কৌতুহলী চোখে রাসেল তাকিয়ে থাকে। নিখিল হাতের ইশারায় ডাকলে ভিতরে এসে মাটিতে বসে পড়ে। নিখিল খাতা থেকে একটা সাদা কাগজ ছিঁড়ে দিলে কি করবে বুঝতে পারে না। অভিভূত হয়ে গন্ধ শুঁকে। গালের ওপর খানিকক্ষন চেপে রেখে উল্কার বেগে বের হয়ে যায়। কোন কোন রাতে যখন নিখিলের ঘুম আসে না, লেখায় গতি আসে না তখন দড়াজ গলায় ডাকে রাসেল। রাসেল দরজার আড়ালে বসে থাকে। কিন্তু এক ডাকে ভিতরে ঢুকে না। যখন দু’তিন ডাক শুনতে পায় তখন এসে ভূতের মতো গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকবে। কিরে কি করিস? দাঁত বের করে হেসে ইশারায় দেখায়, দরজার ওপাশে বসে ছিলাম। তোর ঘুম ধরে না। আবার হাসি, না! আচ্ছা তোর মা’র কথা মনে পড়ে? রাসেল বিস্মিত চোখে নিখিলকে দেখে। তার তাঁকানো দেখে মনে হয়, সে তার ক্ষুদ্র জীবনে এই প্রথম একজনকে দেখছে যে তাকে চোর বলেনি। নিখিল আবার বলে, কিরে মনে পড়ে? রাসেল কি যেন মনে করে ফিক্ করে হেসে উঠে। মা’র অনেক ছবি তার পটে লেখা আছে। দু’একটা ছাড়া বলতে চায় না। কোন কোন দিন কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে যায়। আবার কোন কোন মাসে পূর্ণিমা রাত্রিতে নিখিল দরজার বাইরে চেয়ার টেনে বসে নিজের কথা বলে। ছোট ছেলেটি সে সব কথা খুব মন দিয়ে শুনে এবং সেও নিখিলের মা’কে মা বলে উল্লেখ করে। তবে লেখার কথাই বেশি বলে। যে সমস্ত কথা উচ্চ পর্যায়ের সাহিত্যিকরা শুনলেও তাদের মগজ ভূঁ ভূঁ করবে। সে সমস্ত কথাও এই ছোট ছেলেটিকে বলত। এক সময় এমন হলো, যেন রাসেল সাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষক। আবার কোন কোন রাতে নিখিল লক্ষ করে রাসেলের শরীরের রং অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে তখন নিখিল অল্প অল্প ভয় পেয়ে বলে, যাহ্ ! রাসেল শুয়ে পড় এখন অনেক রাত হয়েছে। কিন্তু রাসেল স্থির ভাবে গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে। নিখিল আবারো বলে, কিরে তোর ঘুম আসে না। রাসেল কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে, না। একটা কবিতা শুনব। নিখিল তখন মধুর স্বরে কবিতা আবৃত্তি করে। রাসেল কবিতা শুনে কখনো অভিভূত হয় আবারা কখনো কখনো কেঁদে ফেলে। একদিন সন্ধ্যা বেলায় রাসেল বলল, দাদা, আমি তোমার সবগুলো লেখা পড়তে চাই। নিখিল প্রথমে খুব করে হাসল, পরে চিন্তা করল এবং তার লেখার প্রথম পাঠক পেয়ে আনন্দে বলল, তাহলে তো তোকে অক্ষর জ্ঞান নিতে হবে। রাসেল গোল গোল চোখে নিখিলের দিকে অনেকক্ষন তাঁকিয়ে থাকল। অবশেষে নিখিল বলল, আচ্ছা ঠিক আছে আজ থেকে তুই পড়তে শিখবি। নিখিল অনেক রাত পর্যন্ত তাকে নিয়ে “স্বরে অ,স্বরে আ”পড়ল। এভাবে কতদিন সপ্তাহ যে কেটে গেল। শ্রাবণ মাস। টানা বৃষ্টি শেষে যখন গ্রামের লোকজন বাইরে বের হচ্ছে। ভেজা গাছের পাতা থেকে স্বর্গের গঁন্ধ মাখানো বাতাস বইছে। পাড়াগাঁয় ঝিম ধরা দুপুরে অচেনা এক পাখি তখন গলা ছেরে গানের রেওয়াজ করছিল। যেন সমস্ত জগৎটা তার। এদিকে নিখিলের হৃদয়ে হাহাকার করে উঠলো। বছর বছর নতুন ক্যালেন্ডারের মতে কত কিছুর না পরিবর্তন হলো। কত রমণী বঁধু বেশে স্বামীর ঘরে গেল । চোখের সামনে কত অযোগ্য লেখকের লেখা ছাপা হলো। এবার যে করে হোক একটা পান্ডুলিপি প্রকাশ করতে হবে। ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। নিখিলের প্রথম পাঠকটি তখন কাঠাল বাগানে চুঁড়–ই পাখির বাচ্চা নিয়ে খেলছিল। নিখিল যখন ব্যাগ, ছাতা নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হচ্ছে তখন রাসেল দৌড়ে এসে সামনে গোল গোল চোখে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। নিখিল বলল, ঢাকায় যাচ্ছি। একটা পান্ডুলিপি প্রকাশ করতেই হবে। রাসেল তখন তার মুখ মোছার গামছাটা দিয়ে নিখিলের স্যান্ডেল পরিষ্কার করতে লাগল। রাসেল কোন কথা বলল না। নিখিল নিজে থেকেই তার কথা বলে যাচ্ছিল। ঢাকায় থেকে ফিরার পথে রাসেল জন্যে কেমন সিলেট চক, আনবে। সে সব কথা। নিখিল ঢাকায় এসে যেন একটা বড় ধরনের ধাঁক্কা খেল। পত্রিকার সম্পাদক ও বই প্রকাশকদের সাথে দেখা করার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। পিয়নদের ধমক খেয়ে পান্ডুলিপি প্রকাশের ইচ্ছা ভুলে গেল। ঢাকা থেকে রাত্রিতে ফিরল। কিন্তু সে বাগান-বাড়িতে গেল না। বর্ষায় নদীর কিনার চোখের অশ্রুর মত ছল ছল করছিল। নদীর পাশে সারারাত ভাঙ্গা মন নিয়ে বসে থাকল। যখন ভোরের পাখিরা জেগে উঠেনি তখন নিখিল ক্ষোভে অভিমানে তার পান্ডুলিপি নদীতে ফেলে দিল। চোখের সামনে দিয়ে রাতে পান্ডুলিপি ভেসে গেল। কত দীর্ঘ রজনী, মধু পূর্ণিমা, বৃষ্টির জলধারা, বসন্ত, লক্ষ নক্ষত্রকে সাক্ষি রেখে চোখের জলে লেখার পাতা ভিজিয়ে রচিত হয়েছিল এই পান্ডুলিপি। তখন হৃদয়ে ব্যাথা অনুভব হলো। ইচ্ছে করলো পান্ডুলিপি তুলে আনতে। কিন্তু তখন পান্ডুলিপি গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে ভেসে গেছে। নিখিল ভাবল, জীবনে এমন কত মৃত্যু আছে! বাগান বাড়িতে যখন ফিরল তখন রাসেল দৌঁড়ে এসে বিস্মিত হয়ে নিখিলের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু নিখিল কোন কথা বলল না। নিঃসঙ্গ প্রবাসে নিখিল রোগে-আক্রান্ত হলো। সব সময় শুয়ে থাকে। এক রাতে রক্ত বমি শুরু হলো। এগারো-বার বছরের ছেলেটি তখন বুঝতে পারল তার দাদা মৃত্যু শয্যায়। সে কবিরাজ ডাকল। সারারাত জেগে জেগে টেবিলের উপর খাটের নিচের সমস্ত পান্ডুলিপিতে আগুন জ্বেলে কাপড় গরম করে নিখিলের গলায় ছ্যাঁক দিলো। শেষ রাতে বমি বন্ধ হলো কিন্তু নিখিল পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলো। রাসেল এরপর কত দিন রাত নিখিলের কন্ঠস্বর শুনতে পেল। স্বপ্ন দেখল। বাগান বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। মনির সাহেবের বন্ধু দেশের বড় এক পত্রিকার সম্পাদক সেখানে ঘুরতে এলেন। নির্জন এক দুপুরে যখন গাছের কমল পাতারা বাতাসে দুলছে তখন সম্পাদক সাহেব ঘুরতে ঘুরতে নিখিলের ঘরটাতে গিয়ে বসলেন। জানালা খুলে দিয়ে গ্রিল ধরে সামনে পুকুরটা দেখতে দেখতে কি যেন ভাবছিলেন। সম্পাদক সাহেব হঠাৎ টেবিলের এক কোনা থেকে দু’টি কাগজ পেয়ে পড়তে শুরু করলেন। বিশ্বাস করতে পারলেন না এমন শক্তিধর একজন লেখক এখানে থাকত। তিনি ছোটগল্পটি পত্রিকায় ছাপালেন। গল্পটি পাঠকদের এত ভালো লাগল যে, ছাপার অক্ষরগুরো পর্যন্ত যেন চোখের সামনে চিৎকার করছে। সাহিত্য একাডেমি এবং দেশের নামকরা প্রকাশক, পাঠক বলা-বলি করতে লাগল এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের আর্বিভাব হয়েছে। অন্যসব পান্ডুলিপির উদ্দেশ্যে পত্রিকার সম্পাদক সাহেব আবার বাগান-বাড়িতে ছুটে গেলেন। সব পরিশ্রম ব্যর্থ হলো। সব শেষে রাসেলকে ডাকা হলো। রাসেলকে নানান প্রশ্ন করল, এখানে নিখিল কখন লিখত, তার আর সমস্ত পান্ডুলিপি কোথাও আছে কিনা। এসব প্রশ্ন। কিন্তু রাসেল কোন কথা বলল না। শুধু গোল গোল হূতমের চোখে তাকিয়ে থাকল। সম্পাদক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন, আহ্! দেশে সাহিত্যের অনেক বড় একটা ক্ষতি হলো। যে দূত বৃহস্পতি, মঙ্গলকে ফেলে পৃথিবীর পৃষ্ঠে এসেছিল, আমাদের ডেকে কোন সারা শব্দ না পেয়ে অভিশাপ দিয়ে ফিরে গেল।
আরও দেখুন: রবিবারের ছোটগল্প