রবিবারের গল্প
ছায়ালাপ
পু জা মৈ ত্র
ছবি:প্রীতি দেব
চুপ চাপ বসে ছায়া গুন ছিল অয়ন । ফ্ল্যাটের বারান্দায় সারা দুপুর রোদ পোহাতে পোহাতে ছায়া গুণতে বেশ
লাগে, হরেক রকমের ছায়া। পাশের পার্কের গাছগুলোর ছায়া, ওদের ডালপালার ছায়া , পাতার ছায়া, আকাশের মেঘের ছায়া , মল্লিকার শখ করে টবে লাগানো সযত্নে লালিত ফুলগাছগুলোর ফুলের ছায়া, ওদের পাঁপড়িরদের ছায়া ,
বারান্দায় কাপড় মেলার দড়ির ছায়া , ওতে টাঙানো কপড় গুলোর ছায়া – গুনতে গুনতে দুপুর কেটে যায় । ভারী মজার , কিন্ত ছায়া গুলো এই আছে , এই নেই । এই একরকম, এই বদলে যায় । অয়ন অনেক করে ওদের সাথে ভাব জমাতে চায়। কথা বলার চেস্টা করে। অথচ ওরা সাড়া-ই দেয় না । অয়নকে আজকাল কেউ পাত্তা দেয় না, মল্লিকাও না।
সেই সকালে অফিসে বেরিয়ে যায়, সন্ধ্যা করে ফেরে। ফিরেও যে অয়নের সাথে দুটো কথা বলবে , তা না , পুপলুকে পড়ানো আর ল্যাপটপ। কাজ যেন শুধু মল্লিকা-ই করছে। অয়নও তো কাজ করত , বড় অফিসে কাজ করত। এই তো বছর দেড়েক আগেও রোজ অফিসে যেত অয়ন , শার্ট ইন করে টাই বেঁধে – তারপর কোথা থেকে যেন কি সব হয়ে গেল । মনে করতে পারে না অয়ন । আবছা আবছা মনে পড়ে কয়েকটা গম্ভির মুখ গোল হয়ে ওকে ঘিরে ধরে ভীষণ বকাবকি করছে । ঐ মুখগুলো কাদের , ভাবতে গেলেই ভীষণ মাথার যন্ত্রণা আরম্ভ হয় । ধ্যাৎ তার থেকে ছায়া গোনা ভাল । মাঝে মাঝে ছায়া ধরতেও যায় অয়ন। ছুঁতে যায়। অথচ কেমন পালিয়ে যায় ওরা । ধরা দেয়না। ওর এই ছায়া ধরা দেখে পুপলুও হাসে। ওর মা ফিরলেই মাকে বারবার করে বলে দেয়, বাবা বারান্দায় বসে ঠিক কি কি করছিল। মল্লিকার মুখে ক্লান্তির সাথে বিরক্তিও ফুটে ওঠে । “সারা দুপুর ওখানে বসে না থেকে পুপলুর পড়াটা একটু দেখতে পারো। বিকালে ওকে নিয়ে একটু পার্কে গিয়ে বসলেও তো পারো” । পুপলু মাথা নাড়ে , “ না মা, আমি বাবার কাছে পড়ব না । বাবা কিছু জানে না। বাবআ তো আস্ত পাগল”। মল্লিকা কড়া চোখে ছেলেকে শেখাই, “বড়োদের কথার মধ্যে কথা না বললেই নয় ! যা পড়তে বোস…”।
“আমি এমনি বলি নাকি , সব্বাই বলে…” । শুনতে শুনতে মাথা ঝিমঝিম করেঅয়নের , ওপাগল !
কই , মনে হয়না তো। পাগলদের একমাথা চুল থাকে ,নাকাটা দাড়ির জঙ্গল থাকে, মাথায় উকুন থাকে, গায়েজামা কাপড় থাকে সবই ছেঁড়া ।আয়নার সামনে দাঁড়ায় অয়ন। কই ? ওর তো পরিস্কার করে কামানো গাল , গায়ে ভালো জামা ,মাথায় উকুন নেই –
তাহলে কেন সবাই বলে ও-পাগল ? সবার কথায় কান দেয়না অয়ন। সবাই কি জানে , ছায়াদের একটা আলাদা দেশ আছে ? ওদের একটা আলাদা ভাষা আছে- কান পেতে শোনে অয়ন। কিছু অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা যায় । ভাষাটা স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবে একদিন ওদের ভাষা ঠিক বুঝে ফেলবে প্রত্যেক মানুষের সাথেই তো একটা ছায়া থাকে। ছায়াকে এড়িয়ে আবার মানুষ হয় নাকি ? এসব ভাবতে ভাবতে সব ভুল হয়ে যায় অয়নের। ভাবে ,প্রত্যেক দুপুরে পুপলুকে পড়াবে – অথচ বারান্দাতেই বসে থাকে। হঠাৎ মনে হয় পার্কের বেঞ্চে অনেক দিন বসা হয়নি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পুপলুর ঘরে উঁকি মেরে দেখে ও- ঘুমোছে। স্কুল থেকে ফিরে , খেয়ে দেয়ে ঘুমোবে এখন। আগে বিকেলে সামনের পার্কে খেলতে যেত। এখনও রমা ওকে যেতে দেয়না। অয়নের উপর নজরদারি করতে বাড়িতে থাকতে হয় ওকে। পুপলুর জন্য খারাপ লাগে অয়নের । পার্কে ওর বয়সের বাচ্ছা গুলো যখন খেলে বেড়ায়, তখন মুখ শুঁকনো করে ঘরে বসে থাকে ছেলেটা। মল্লিকারও যত উল্টোপল্টা কাজে। পুপলু অয়নের বাবা, না অয়ন পুপলুর বাবা? অয়নকে নজর বন্দী করে রাখার দরকারটা কি? অয়ন কি ছোট্ট নাকি? আর ঐটুকু ছেলের সাধ্যকি অয়নকে ম্যানমার্কিং করে? এইতো দিব্যি দরজা খুলে বেরিয়ে গেল অয়ন। পুপলুতো টেরই পেলনা। পার্কে গিয়ে বসে ছিল অয়ন।
পার্কের ঐদিকে পুকুর আছে একটা। পুকুরের পাড়ে বসে জলে ছায়া দেখছিল মাছগুলো বড্ড জ্বালাতন
করছিল ।মাঝে মাঝে সত্যিই জলে ভুড়ভুড়ি কেটে ছায়াগুলকে নষ্ট করে দিচ্ছিল ।আর ছায়াগুলো ভেঙে যাছিল । কচুরিপানার ছায়াগুলো বড্ড শান্ত । মাছগুলোকে বকে দিতে পারছিল না। ওদের দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যাচ্ছিল যেন । হঠৎ একটা বাচ্চা পাশে এসে বসল , পুপলুর মত বয়স । চুলগুলো উস্কো খুস্কো । এই শীতেও গায়ে পাতলা গেঞ্জি একটা । মাছগুলকে মুড়ি খাওয়াবে ।
বিরক্ত হল অয়ন, “কি করবি এখানে ?”
ছেলেটা হাসল, “মাছগুলকে মুড়ি দেব , কাকু” ।
কাকু বলল !
ছেলেটা ভদ্র তো বেস! অয়ন খুশি হল,
“কি নাম তোর ?” “রাজু”।
“কোথায় থাকিস?”
“এই তো পাশে”।
“পাশে মানে ?”
“ঐ চায়ের দোকানটায় কাজ করি”। চমকে উঠল অয়ন।
কাজ করে, এইটুকু ছেলে !
“কাজ করিস ? কেন? তোর মা বাবা কিছু বলে না ?”
রাজু পুকুরে মুড়ি দিতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষনে। মাছগুলোও ঘাই দিতে শুরু করেছে । বেশ বড় বড় মাছ। রুই , কাতলা …
“মা-ই তো পাঠাল”। ছোট করে জবাব দিল রাজু ।
“কেন? মা চায় না তুই পড়িস”?
রাজু মাথা নাড়ল , “পড়তাম মা ছাড়িয়ে দিল । বলল আর পড়ে কাজ নেই , বাপটার চাকরি গেছে।
কারখানায় কাজ করত । চাকরি চলে যেতে পাগল হয়ে ঘর থেকে চলে গেছে ।মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে
আরো দুটো ভাই আছে । মা একা পারে না….”। মুখস্তের মত জবাব দিল রাজু ।
এই উত্তরটা ওকে অনেকের কাছেই দিতে হয় তাহলে । সব যেন গুলিয়ে জাছিল অয়নের । ওরও তো চাকরি চলে গেছে । লোকে বলে অয়ন পাগল । তাহলে ও চলে গেলে পুপলুও কি চায়ের দোকানে কাজ করবে ? নাকি ওরই ভুল হচ্ছে ।এই ছেলেটা রাজু নয় , পুপলুই । অয়নই চিনতে পারছে না। ছেলেটাকে আপন করে ওকে কাছে ডাকল অয়ন । গা মাথায় হাত বুলিয়ে দিল , অবাক হয়ে রাজুর চোখের দিকে তাকাল তারপর বলল, “কে বলল তোর বাবা নেই ? তাকিয়ে দেখ … এই তো আমিই তোর বাবা”। চমকে উঠল রাজু । ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে এমন ভাব করে দূরে সরে গেল ।
“কি হল?… আয় …পুপলু…”
অয়ন স্নেহের স্বরে ডাকল ।
“না যাব না , তুমি পাগল ,বাবার মত তুমিও”…। একছুটে পালিয়ে গেল রাজু । অয়ন অবাক হয়ে বসে থাকল । সন্ধ্যের একটু আগেই বাড়ি ফিরল অয়ন । মল্লিকা না ফিরলেই ভালো । কিন্তু অয়ন যা ভাবে ,উল্টোটা-ই হয়। ডোরবেল টিপতেই দরজা খুলল মল্লিকা ।থম থমে মুখ ।
বেশ রেগে আছে ।
“পার্কে গিয়েছিলাম, ঘুরতে”। হেসে পরিস্থিতি সহজ করতে চাইল অয়ন।
“বাঃ খুব ভালো”, সংক্ষিপ্ত জবাব দিল মল্লিকা ।
“হাত মুখ ধুয়ে নাও ,জল খাবার রেডি”।
“পুপলু কোথায়”? আস্তে করে জিজ্ঞাসা করল অয়ন ।
“দোষ কর তুমি আর শাস্তি পায় ও”। নিস্প্রিহ মুখে বলল মল্লিকা ।
অয়ন অবাক চোখে তাকাল ।
“ওরকম করে তাকাবার কিছু নেই ।ওর দায়িত্ব তোমাকে চোখে চোখে রাখার ,রাখতে
পারোনি তাই ওর ঘরে ওকে কান ধরে এক পা তুলে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি ”।
“ওর লাগবে যে”! অয়ন অস্ফুটে বলল ।
“সেটা ওর বাবার বোঝা উচিৎ । এইরকম খামখেয়ামলি কাজকর্ম না করলেই হয় ।
আর ছেলেকে এই বয়স থেকেই দায়িত্ব নিতে শেখাতে চাই আমি ।দায়িত্ব এড়িয়ে ঘরে বসে থাকতে
যেন না শেখে”। শেষের কথাগুলো অয়নকে উদ্দেশ্য করেই বলা ।মল্লিকাকে এই মুহুর্তে খুব
অচেনা লাগল। পুপলুকে দায়িত্ব ভাগ করার জন্য কাজে লাগিয়ে দেবে না তো মল্লিকা। দিলেও বা তখন
কি করবে ? ঠেকাবে কি করে ? বড্ড অসহায় লাগল নিজেকে ।
“পুপলু”— মল্লিকা ডাকল । বাবা এসে গেছে ,জল খাবার খাবে এসো”। অয়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে ধৈর্য্য চ্যুত হল মল্লিকা , “যাও ! ফ্রেশ হয়ে এস”।
অয়ন চলে যেতে উদ্যত হল ।পুপলু এল । কেঁদে কেটে দু’চোখ লাল । অয়ন থমকে
দাঁড়াল। ওর জন্য পুপলু শাস্তি পেল …? পুপলু কে কাছে ডেকে আদর করতে ইছা হল অয়নের। হাত
বাড়াবে , হঠৎ অয়নকে অবাক করে পুপলু ওর মাকে জড়িয়ে ধরল ।মল্লিকা ছেলের মাথায় আদরের হাত রাখল , “চোখ মোছো খাইয়ে দেব চলো। বাবা আর ওরকম যাবে না ।বলেছে আমায়”।
পুপলু অয়নের দিকে তাকাল ।রাগ, অভিমান না ঘেন্না কোনটা ওর চোখে ঝলাস করে উঠল বুঝতে না পেরে অয়ন বাথরুমে চলে গেল ।
রাতে এখন মল্লিকা পুপলুর ঘরেই শোয় । অয়ন একলা নিজের ঘরে , মল্লিকা
রাতে যে ওষুধগুলো দিয়ে যায় ও-গুলো খেলে খুব ঘুম হয় রোজ ।আজ ঘুম আসছিল না ।টিউব লাইট
জ্বালিয়ে নিজের হাতের ছায়া দেওয়ালে ফেলে খেলবে ভাবল একবার । না, না… এখন ছায়া নিয়ে খেলতে ভালো লাগছে না। এখন কী একটা যেন চাই ওর । জল তো একটুক্ষণ আগেই খেল। তাহলে?
মল্লিকাকে ডাকবে ? মল্লিকা বলতে পারবে হয়তো। একটুক্ষণপর অয়ন বুঝল , ওর এখন মল্লিকাকে চাই। এরকম তো অনেকদিন হয়না। অথচ আজকে হঠাৎ কেন? একবার যাবে পুপলুদের
ঘরে? ওর মা’ কে ডাকবে ? সত্যিটা বলেই ডাকবে না হয় । আসবে, মল্লিকা? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে
উঠেই পড়ল অয়ন । ড্রয়িং রুম পেরিয়ে ওদের ঘরের সামনে এলো । দরজা ভেজানো , নাকি? না বন্ধ।
ভিতর থেকে বন্ধ ।সাহস করে ডাকতে যাবে হঠাৎ কথার আওয়াজ পেল অয়ন। কান করল, হ্যাঁ !
মল্লিকার গলা ।ফিসফিস করে কথা বলছে। কার সাথে কথা বলছে। ডাকতে গিয়েও থেমে গেল অয়ন।
হেসে ফেলল নিজের মনে । ওঃ! তাহলে মল্লিকাও ওরই মতো। ছায়ার সাথে কথা বলে। অয়ন দিনে
বলে, আর মল্লিকা রাতে। কিন্তু বলে। সবাইকে ছায়ার সাথে কথা বলতেই হয়। তাও সবাই অয়নকেই
পাগল বলে । মনে মনে আবারো হাসল অয়ন ।তাহলে মল্লিকাও তো …থাক, মল্লিকাকে জানতে দেবে
না অয়ন, সে জেনে গেছে মল্লিকাও আসলে অয়নেরই মতো। চিন্তাটা অনেক কমল আজ । মল্লিকা আর
যাই হোক ,রাজুর মায়ের মত হবে না । নিজেকে সামলে নিয়ে শুতে চলে গেল অয়ন।
আরও পড়ুন: ভ্রমণ কাহিনী