Home / রবিবারের আড্ডা / রবিবারের ছোটগল্প অবসাদের দাওয়াই লিখেছেন শর্মিষ্ঠা দত্ত

রবিবারের ছোটগল্প অবসাদের দাওয়াই লিখেছেন শর্মিষ্ঠা দত্ত

ছোটগল্প

অবসাদের দাওয়াই

শ র্মি ষ্ঠা দ ত্ত

গল্প

ছবি: প্রীতি দেব


স্বাতী একজন মধ্যবয়সিনী গৃহবধূ ; স্বামী ও একমাত্র পুত্রকে নিয়ে মোটামুটি নিরুদ্বেগ ও নিস্তরঙ্গ জীবনযাপন করে। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ভিতটা বেশ মজবুত l চারপাশে তার চেনাশোনা প্রায় সব মানুষই নিজেদের জীবনের কোনো না কোনো সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ।শুধু তারই কোনো ব্যস্ততা নেই ! খবরের কাগজে, টিভিতে শুধু মানুষের জীবনের ক্রাইসিসের খবর। ইদানিং এই ক্রাইসিস না থাকাটাই তার জীবনের একমাত্র ক্রাইসিস। তাই স্বাতীর একটা মনখারাপের অসুখ হয়েছে l আপাত কোনো কারণ না থাকলেও রোজই নিয়মমাফিক মনখারাপ হয় তার l

তেমন সচ্ছল পরিবারে না জন্মালেও রূপের জোরে বিয়ে হয়েছিল রীতিমত ধনী পরিবারে l স্বামী অমিত রায় ইঞ্জিনিয়ার এবং রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার একজন আধিকারিক। খুবই ভদ্র ও মিতভাষী। স্বভাবচরিত্রও সন্দেহাতীতভাবে ভাল l ছেলে শুভজিৎ ওরফে পাপানও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা নামকরা আই টি সংস্থায় চাকরি করছে l বিয়ের পর থেকেই স্বাধীন সংসার তার।শাশুড়ি-জা-ননদের সঙ্গে ঘর করতে হয়নি l তেমন কোনো আর্থিক বা সাংসারিক সমস্যার মুখোমুখি হতেও হয়নি সারা জীবনে। অর্থাৎ সুখে থাকার কাঙ্খিত সব রসদ-ই মজুত।তবু মনের মধ্যে কি যেন নেইবোধ! ব্যবহারিক জীবনেও তার ছাপ পড়ে বৈকি ! স্বাতীর মনখারাপের প্রভাবে অমিতবাবু এবং পাপান সর্বদা শশঙ্কিত !

পাপান আর তার বাবা দুজনেই খুব কম কথা বলে। তাই পাড়ার লোকের সঙ্গে গল্পগুজব প্রকারান্তরে পি.এন.পি.সি করেই অনেকটা সময় কাটত স্বাতীর। তাছাড়া আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ফোনে গাল-গল্প তো চলতই l কিন্তু প্রথমত টিভি ; তারপর ঘরে ঘরে কম্পিউটার এবং সম্প্রতি সকলের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন এসে সকলেই এখন যারপরনাই ব্যস্ত। স্বাতীর জন্য কারুরই সময় নেই l বাঙালির একান্ত নিজেস্ব পরচর্চার সংস্কৃতিটা যেন উধাও-ই হয়ে গেছে এখন l টিভি সিরিয়ালের একঘেয়ে ষড়যন্ত্রগুলোও আজকাল আর টানে না স্বাতীকে, তবু অভ্যাসবশত টিভিটা চলতেই থাকেl ছোট্ট সংসারে রান্নাবান্না বা ঘরের কাজ করেও প্রচুর অবসর।অতএব মনখারাপ করার জন্য সময়ের অভাব নেই তার l

এই যে সারাজীবন অমিতবাবুর মত একজন নিরেস, আনরোমান্টিক লোকের সঙ্গে ঘর করল, যাকে এই দীর্ঘ সাতাশ বছরে দুটো প্রেমের কথা বলতেও শোনেনি। দুঃখ -আনন্দ কোনো কিছুতেই কোনদিন রিয়্যাক্ট করতেও দেখেনি।এ-নিয়ে আক্ষেপে চোখে জল এসে যায় তার l পাপানের মত শান্ত ছেলে, যে কিনা ছোটবেলা থেকেই ভাল ছেলের উদাহরণ হয়ে রয়েছে সকলের কাছে। কিন্তু সে তো জানে কি ভয়ংকর জেদী আর হৃদয়হীন ছেলে তার।মাকে পাত্তাই দেয়নি কোনদিন! এমনকি নিজে এম.এ পাশ করেও কেন চাকরি-বাকরি করার কথা ভাবেনি, অন্য সকলের মত কম্পিউটারটাও শিখে উঠতে পারেনি এতদিনে, এসবই তার অবসাদের কারণ !

মাস ছয়েক হলো দীর্ঘ দু-বছরের প্রেমপর্ব শেষে তানি আর পাপানের বিয়ে হয়েছে l প্রথমে ঘোর আপত্তি থাকলেও এরমধ্যেই তানিকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে স্বাতী l আসলে একমাত্র ছেলের বিয়ে দেখে শুনে দেয়ারই ইচ্ছে ছিল তার।চাকরি-করা বৌ তার ঘোরতর অপছন্দ। কিণ্তু পাপান সেই সুযোগই দিলো না ! তবে প্রথম যেদিন পাপান তানিকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল সেদিনই তানির মিষ্টি মুখ আর ততোধিক মিষ্টি ব্যবহারে গলে জল হয়ে গিয়েছিল স্বাতী।তৎক্ষণাৎ মাফ করে দিয়েছিল পাপানকে l বিয়ের পর প্রথমদিকে বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল তানিকে নিয়ে l তানিও বেশ সময় দিত তাকে তখন-একসঙ্গে শপিং অথবা বিউটিপার্লারে যাওয়া, নতুন নতুন রেসিপি শেখানো, ল্যাপটপে একসঙ্গে সিনেমা দেখা …. মনখারাপগুলো তখন কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল l কিন্তু তানির নতুন প্রজেক্ট শুরু হওয়ার পর থেকেই সে এখন এমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে যে আর তেমন সময় দিতে পারে না স্বাতীকে। তাই লুকোনো চিলেকোঠা থেকে মনখারাপগুলো নেমে এসে আবার এসে আস্তানা গাড়তে শুরু করেছে স্বাতীর মাথায় l

জুলাই মাস ।সারাদিন অবিরাম বৃষ্টি ।স্বাতীর মনখারাপের এটাই যথেষ্ট কারণ l পরপর কয়েকদিন অফিস থেকে ফিরে শাশুড়ির খিটখিটে মেজাজ আর বাংলার পাঁচ-মার্কা মুখ দেখতে দেখতে একটা আইডিয়া এলো তানির মাথায় l এরমধ্যেই স্বাতীর জন্মদিন। সেদিন অফিস থেকে ফিরে একটা রঙিন কাগজে মোড়া বাক্স দিল তানি, “মামমাম, এটা তোমার বার্থডে গিফট ।”

বাক্সের মধ্যে বেশ বড়সড় একটা স্মার্ট ফোন ! তানি বসে বসে অসীম ধৈর্য্য নিয়ে তার ব্যবহার শেখাতে লাগল শাশুড়িকে l যদিও পাপান বারণ করেছিল, তবুও সোশ্যাল মিডিয়াতে সময় কাটালে ডিপ্রেশন কেটে যাবে, তারাও শান্তিতে থাকতে পারবে এই যুক্তিতে ফেসবুক আর ওয়াটস অ্যাপ অ্যাকাউন্টও খুলে দিলো। ফেসবুকে স্বাতীকে নিজের ফ্রেন্ডও বানিয়ে নিল তানি l বাড়িতে সে ছাড়া বাকি দু-জন মানুষও স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে, সোশ্যাল মিডিয়াতেও অ্যাকটিভ, তবু এতদিন কেন মামমামের জন্য ওরা এটা ভাবেনি, কে জানে!

মোবাইল ফোন একটা ছিল স্বাতীর। তাই প্রথমে নতুন ফোনটা নিয়ে খুব একটা উৎসাহিত হয়নি l কিণ্তু ফেসবুকে অন্যদের হাঁড়ির খবর নিতে নিতে একটু একটু করে কখন যেন এই ফোনটাই তার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছেl পরচর্চার এই নতুন মাধ্যমটাকে পেয়ে মনখারাপগুলোও ক্রমশ অদৃশ্য! আগে যখন অন্যদের ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখত তখন রাগ হত খুব। মনে হতো, সবাই ইচ্ছে করেই তাকে ইগনোর করছে ; খুব জটিলও মনে হত ব্যাপারটা।এখন অবশ্য এটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়। নিজে নিজেই অনেক কিছু শিখে গিয়েছে।স্মার্ট ফোন হাতে নিয়ে নিজেকেও আজকাল বেশ স্মার্ট মনে হয় স্বাতীর!

ফেসবুকে এখন তার অনেক বন্ধু। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে নতুন করে।নতুন বন্ধুও হয়েছে কয়েকজন l যদিও তানি বারবার করে সাবধান করে দিয়েছে চেনা মানুষ ছাড়া ফ্রেন্ডশিপ না করতে; তবুও একটা নিষিদ্ধতার আনন্দ চেটেপুটে উপভোগ করার নেশায় ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে স্বাতীর।তা তানিকে জানায়নি অবশ্য ! আর তানির এত সময়ও নেই এসব খেয়াল করার। সে ব্যস্ত তার অফিস আর বন্ধুবান্ধব নিয়েl বেশ কিছু স্তাবকও জুটেছে স্বাতীর। আসলে অন্যদের পোস্টে লাইক, কমেন্ট করা ছাড়াও এখন নিজেরও প্রচুর ছবি পোস্ট করে। সেল্ফিও! সেই কোন কিশোরীবেলায় বিয়ের পরে রূপের প্রশংসা পাওয়ার অভ্যেসটা হারিয়েই গিয়েছিল, এর আগে তো কোনদিন ভাবেইনি যে এ- বয়েসেও রূপের এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পাওয়া যায়! মন ভাল করার এই দাওয়াইটা যদি আগে জানতো! শাশুড়ির মেজাজের পরিবর্তনে তানিও বেশ স্বস্তিতে আছে এখন। মনখারাপের ব্যামো সারানোর ক্রেডিটও নিয়েছে পাপানের কাছে! এ-বাড়িতে এখন অখণ্ড শান্তি বিরাজমানl যে যার নিজের জগতে আবর্তিত।স্বাতীও তার নিজের জগৎ নিয়ে মশগুলl

স্বাতীর এখন প্রচুর বন্ধু। তারই মত সাংসারিক দায়মুক্ত মাঝবয়েসী মহিলা সবl ফেসবুকে চ্যাট করা ছাড়াও প্রায়ই কোনো না কোনো শপিংমলে অথবা রেস্তোরাঁতে আড্ডা বসে তাদের।মাঝে মাঝে দল বেঁধে বেড়াতেও যায় এই চল্লিশোর্ধ কিশোরীরা! তারপর সেসবের ফটো তুলে কেউ না কেউ ফেসবুকে পোস্ট করে অন্য বন্ধুদের ট্যাগ করে, অগুনতি লাইক আর কমেন্টের বন্যা সেখানেl দু-একজনের কমেন্টে তো রীতিমত শিহরিত হয় সে।এ বয়েসে এত কিছুও পাওয়ার ছিল! ভার্চুয়াল ওয়র্ল্ডে বন্ধুত্বের নেশায় মনখারাপ যে কোনো দূরের গ্রহে পালিয়েছে। মনেও পড়ে না l সেদিন বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মল থেকে কয়েকটা মড ড্রেস কিনে ফেলেছে। কিন্তু তারপর না পারছে ওগুলো পরতে, না পারছে কাউকে দেখাতে l যে স্বাতী ক্লাস নাইন থেকে শাড়ি পরতে অভ্যস্ত সে এখন আটচল্লিশে এসে জিন্স পরে ঘুরবে কিভাবে! অথচ ওই ড্রেসগুলো পরে ফটো পোস্ট করার জন্য মনটা যে ছটফট করছে ! একবার ভাবল ড্রেসগুলো তানিকে দেখাবে, কিণ্তু লজ্জায় কিছুতেই আর দেখিয়ে উঠতে পারল নাl সুযোগ অবশ্য এসেই গেল, চারজন মহিলা তাজপুর-মন্দারমণি বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করেছে। ফেসবুকেরই বন্ধু সবাই। স্বাতীও জুটে গেল ওদের সঙ্গে l লাগেজ গোছানোর সময় চুপিচুপি ড্রেসগুলো ব্যাগে চালান করল সে।

আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছে তানি l ডিনারটা আজ অনলাইনে অর্ডার করে বাড়িতে আনিয়ে নিয়েছে একটা রেস্তোরাঁ থেকে। মামমাম তিনদিনের জন্য ঘুরতে গেছেI কাল রান্না করেছিল। রোজ রোজ সংসারের দায়িত্ব মামমাম যে কি করে সামলায়! একদিনেই বিরক্ত লাগছে তানিরl মামমামের যে তিনদিনের জন্য যাওয়ার কি দরকার ছিল! অফিস থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে রাতে ফোনটা নিয়ে বসল তানি l কাজের চাপে অনেকদিন ফেসবুক খোলা হয় না। আজ একটু সময় পেয়েছে … নেট অন করে ফেসবুকে লগ ইন করতেই চমকে গেল শাশুড়ির ছবি দেখে, সত্যিই মামমাম তো! একেবারেই অন্যরকম লাগছে। শুধু জিন্স নয়, আরো কিসব মড ড্রেস পরে ছবি তুলে আবার ট্যাগিয়েছে তানিকে! পোস্টটা করেছে ঘন্টা চারেক আগে, এর মধ্যেই পঁচানব্বইটা রিঅ্যাকশন আর ছাপ্পান্নটা কমেন্ট! তানির বন্ধুরাই তো লিখেছে, “বিউটিফুল আন্টি।ইউ আর লুকিং সো প্রিটি এন ইয়ং…।” আরো কত কি! তার নীচে আরো কিসব সেনসেশনাল কমেন্ট। এরা আবার কারা! পই পই করে মামমামকে বলেছিল সে, অচেনা লোকের সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ কোরো না। মাথাটা গরম হয়ে গেল তানিরl উফফ! কি কুক্ষণে যে জন্মদিনে মামমামকে স্মার্ট ফোন গিফট করতে গেল!

পাপান ল্যাপটপে একটা প্রেজেন্টেশন বানাচ্ছিল,ওকে তানি বলল, “দেখো তোমার মায়ের কীর্তি!” রাগে গজগজ করতে করতে তানি ফোনটা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে। “তুমিই দেখো!” ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল পাপান, “আগেই বলেছিলাম, দিও না। ঠিকমত হ্যান্ডল করতে পারবে না। শুনলে না তখন। তোমারই তো শাশুড়িকে স্মার্ট বানানোর শখ হয়েছিল…।”

অন্য ঘরে অমিতবাবু তখন নিজের বৌয়ের ফটোর নীচে লাভ রিঅ্যাকশন দিয়ে কমেন্ট লিখলেন, “অনন্যা “! এর আগেও অন্য প্রোফাইল থেকে আরো কয়েকটা প্রশংসাসূচক বাক্য লিখেছেন এবং আজকাল নিয়মিতই লিখে থাকেনl কোনোটা-ই অবশ্য নিজের নামে নয়! ফেসবুকে তাঁর এই প্রোফাইলটার নাম “অ্যান আননোন প্ল্যানেট “। অন্যান্য নামে আরো কয়েকটা ফেক প্রোফাইল আছে তাঁর। অবশ্যই সকলের অজান্তে ! যারা কিনা ফেসবুকে স্বাতীর অন্যতম স্তাবক বন্ধু …

বৌয়ের মনখারাপ সারানোর অব্যর্থ দাওয়াই এখন জানা হয়ে গেছে অমিতবাবুর। গৃহশান্তি বজায় রাখার জন্য এইটুকু পদস্খলন না হয় হলোই এই বয়েসে !

আরও পড়ুন: রবিবারের ছোটগল্প দখল লিখেছেন ইভান অনিরুদ্ধ

Check Also

গল্প

রবিবারের ছোটগল্প চাঁদ ছোঁয়ার গল্প লিখেছেন সাগরিকা রায়

ছোটগল্প Illustration: Preety Deb কচু গাছের আড়ালে দাঁড়ালেও চান্দু নিজেকে বেশ লুকোতে পারে।গজু বলে, ভাই …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *