ছোটগল্প
Illustration: Preety Deb
রাত তখন দুটো কী তিনটে হবে। অভ্যেস বশে পাশ ফিরে মেহুলকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েই আচমকা ঘুম ভেঙে গেল সায়নের। মেহুল পাশে নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। হয়তো ওয়াশরুমে আছে। প্রায় মিনিট দশেক পর উঠে পড়ল সে। তাদের চারতলার ফ্ল্যাটের মাস্টার বেডরুমে তখন আলো আঁধারের মায়ার খেলা চলছে। ফিকে নীল ফুটল্যাম্পের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে সাদা মার্বেলের মেঝে। আর ওপরের দিকে আবছা অন্ধকার। ওয়াশরুম ফাঁকা! হালকা স্বরে মেহুলের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সে ঘুম চোখে চলে এল ড্রয়িংরুমে। ব্যালকনির দরজাটা একটু ফাঁকা হয়ে আছে। ঘরে ঢুকছে একফালি নিয়ন আলো।
যা ভেবেছিল ঠিক তাই ঝুল বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেহুল। গাঢ় নীল নাইট গাউনের ওপর স্ট্রিট লাইটের ছটা এসে পড়ছে। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে মেহুলকে। সে কাছে এসে অস্ফুটে বলল,
-আজ আবার ঘুম এল না?
একটু যেন চমকে উঠল মেহুল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-এসেছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকল না। স্বপ্ন, সেই স্বপ্নটাই আবার… কতগুলো গরিব, অভুক্ত মানুষের নগ্ন-ছায়ামূর্তি! আচ্ছা সায়ন আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
-ধুর, সেদিন ডঃ সেন কী বললেন তুমি তো নিজের কানেই শুনলে। খুব বেশি টেনশন, অ্যাংজাইটিই এসব ভুল-ভাল স্বপ্নের কারণ। তুমি ওষুধগুলো খাচ্ছ তো নিয়ম করে?
-হুম খাচ্ছি।
-আমি কার্শিয়াঙের অনাথাশ্রমের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। দত্তকের ব্যাপারটা ভাবছি এবার ফাইনাল করে ফেলব। একটা বাচ্চা এলে তুমি অন্যমনস্ক থাকবে। এসব স্বপ্নটপ্নও তখন আর দেখবে না, আমার বিশ্বাস।
-অনাথাশ্রম? নাহ, তুমি তো জানো সায়ন, এসব জায়গায় আমি যেতে পারিনা। কতগুলো অসহায় বাচ্চা, উফ!বড্ড অস্বস্তি হয় আমার।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মেহুল। তারপর বলল,
-আমার পিসতুতো বোন কুহেলিকে মনে আছে তোমার? ও এখন চেন্নাইতে থাকে। অরিত্র ওর স্বামী, একটা সফটওয়্যার কম্পানিতে জয়েন করেছে। সেদিন ফোনে বলছিল একবার অ্যাপোলো হসপিটালে গিয়ে দেখাতে। সেখানে অনেক বড় বড় গাইনোকলজিস্ট আছেন। যাবে সায়ন? একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি।
২.
-ইনক্রেডিবল! এই বুটিকের শাড়ির কালেকশনের কোনও তুলনা নেই। কী বলিস?
মেহুলের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল সুলগ্না। মেহুলের বন্ধু।
-সত্যিই তাই। দ্যাখ না লোভে পড়ে কতোগুলো কিনে ফেললাম। জানি সায়ন খুব বকুনি দেবে। কিছুই পরা হয়না তেমন। শুধু শুধু আলমারি বোঝাই করা।
দু’জনের মুখেই হাসি উথলে উঠল।
-শোন মেহুল আজকে ক্লাবের মান্থলি পার্টিতে কালো ভাগলপুরি সিল্কটা পরিস। আর সঙ্গে অনলাইনে কেনা ওই স্লিক সিলভার জুয়েলারিটা। সব্বাই পুরো বোমকে যাবে।
কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছিল সুলগ্না। হঠাৎ খেয়াল হল, সে একাই হাঁটছে। মেহুল নেই। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সে দাঁড়িয়ে আছে একটা ডাস্টবিনের সামনে। কতগুলো ধুলো ময়লা মাখা ছেলে মেয়ে প্লাস্টিক ঘাঁটছে। মেহুল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
-অ্যাই মেহুল কী দেখছিস?
চমকে উঠল মেহুল। তারপর অন্যমনস্ক ভাবে আবার হাঁটতে লাগল। কোনও কথাই যেন তার কানে ঢুকছিল না। আচমকা সুলগ্না তাকে টানতে টানতে নিয়ে এল একটা ফুচকার দোকানের সামনে।
-চল ফুচকা খাই। অনেকদিন সুযোগ হয়না খাওয়ার। ভাই একটু বেশি করে ঝাল দিও কেমন।
মনের সুখে ফুচকা খাচ্ছিল দু’জন। তিন চারটে খাওয়া হয়েছে সবে। এমন সময় সুলগ্নাকে অবাক চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করল মেহুল। একটা ফুটফুটে ফর্সা মেয়ে। বয়স পঁচিশ কী ছাব্বিশ হবে। খয়েরি রঙের চুল তার সারা পিঠময় ছড়িয়ে আছে। হালকা বাদামি রঙের চোখ। মেয়েটির শরীরে একটুকরোও কাপড় নেই! তার সম্পূর্ণ নগ্ন দেহে জমেছে ধুলো-কালির পরত। সে কী যেন বলছে নিজের মনে। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। সারা রাস্তার লোক হাঁ করে দেখছে উন্মুক্ত নারী শরীরটাকে। গিলছেও।
মেহুলদের পাশে এসে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে আবার এগিয়ে গেল নিজের রাস্তায়। কেমন একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছিল মেহুলের। লজ্জ্বা, ঘৃণা নাকি করুণা? বুঝতে পারছিল না সে। সুলগ্না তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
-ইশ!এভাবে ঘুরছে মেয়েটা! ওকে তো ছিঁড়ে খাবে পশুগুলো!
ফুচকার বাটি ফেলে হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল মেহুল। সুলগ্না চেঁচিয়ে বলল,
-দাঁড়া মেহুল আমিও আসছি।
কিন্তু সে কোনও কথাই শুনল না। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলও না একবার। সোজা বাড়ি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে ধপ করে বসে পড়ল ড্রয়িং রুমের সোফায়। তার হাত থেকে পড়ে গেল নতুন শাড়ি-ভর্তি ব্যাগটা। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সে দামি ডিজাইনার শাড়িগুলোর দিকে। কিন্তু চোখের সামনে ভাসছিল সেই নগ্ন মেয়েটার ছবি।
৩.
প্রায় দিন-সাতেক হল ডাক্তার দেখানো হয়ে গিয়েছে। এশিয়ার নামকরা গাইনোকলজিস্টদের মধ্যে একজন ডঃ ভি. গণেশন সবরকম পরীক্ষা করে জানিয়েছেন মেহুলের পক্ষে সন্তান ধারণ করা কখনও সম্ভব নয়। বড্ড ভেঙে পড়েছে সে। মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসছে একটাই কথা, এ জন্মের মতো মাতৃত্বের স্বাদ তার অধরাই থাকল। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মেহুলকে নিজের বুকে আগলে রেখেছে সায়ন। অফিস থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা দক্ষিণ ভারত। লক্ষ্য মেহুলের মন ভাল রাখা। একটু আনন্দ দেওয়া।
তিরুপতি, কন্যাকুমারী, রামেস্বরম, মহাবলীপুরম হয়ে তারা এখন এসেছে পন্ডিচেরি। তখন অনেক সকাল। একটু পরেই সূর্য উঠবে। সায়নকে বেঘোরে ঘুমোতে দেখে নাইট ড্রেস চেঞ্জ করে গেস্ট হাউস থেকে একাই বেরুল মেহুল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল সি বিচে। গত রাত্রে আশ্রমের শান্ত পরিবেশে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে দু’জন এসেছিল এখানে। বসে ছিল অনেকক্ষণ। অন্ধকার উত্তাল সমুদ্রের রূপ সত্যিই ভোলার নয়। লোনা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছিল চোখে-মুখে। দূরে টিমটিম করে জ্বলছিল জেলেদের স্টিমারের আলো। কিন্তু এই সাতসকালের সমুদ্রের সৌন্দর্যও কিছু কম নয়। অনেকটা তফাতে যেখানে সমুদ্র গিয়ে আকাশটাকে ছুঁয়েছে সেখানে দেখা যাছে লালচে আভা। সূর্য ওঠার আর বেশি দেরি নেই বোধহয়।
একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল মেহুল। কাল আশ্রমে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বেশিরভাগই বাঙালি। নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত মানুষগুলো জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছাশ্রম, আশ্রমিক জীবন। কেউ ফুল তুলছেন, কেউ ঝাড় দিচ্ছেন, কেউ কেউ ব্যস্ত আছেন সংগ্রহশালায়। আবার কেউ গেটের কাছে বসে খেয়াল রাখছেন দর্শনার্থীদের জুতোর। কারও ডিউটি রান্নাঘরে, খাবার পরিবেশনে। যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে মেহুল।
এমনই একজনের সঙ্গে দেখা হয়েগেল সি বিচে। শান্ত সৌম্য এক প্রৌঢ়া। কলকাতার একটা কলেজে পড়াতেন। একমাত্র সন্তান এখন বিদেশে সেটেল্ড। স্বামীর মৃত্যুর পর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে চলে এসেছেন ঋষি অরবিন্দ আর শ্রীমার আশ্রয়ে। মেহুলকে দেখে পাশে এসে বসলেন। এক কথা দু কথায় জমে উঠল ভাব। কেমন যেন একটা আন্তরিকতা ছিল তাঁর ব্যবহারে। মুগ্ধ হচ্ছিল মেহুল। নিজের অজান্তেই মনের ভিতর জমে থাকা কষ্টের ঝাঁপি তাঁর সামনে উপুর করে দিল সে। ধৈর্য্য ধরে তিনি শুনলেন তার সব কথা। তারপর পরম মমতায় হাত রাখলেন মেহুলের মাথায়।
সমুদ্রের ওপারে লাল আভাটা তখন ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল। একটু একটু করে উঠছে সূর্য। চারদিকে ভরে যাচ্ছে নতুন আলো। মেহুলের নাকে আসছিল একটা কেমন অচেনা গন্ধ। বুক ভরে উঠছিল তার নতুন আলোর সৌরভে।
৪.
আজ সারাটাদিন খুব ব্যস্ততায় কাটবে মেহুলের। সেদিন সমুদ্রের ধারে সেই সূর্য ওঠার সকালে তার পাশে বসে থাকা প্রৌঢ়া তাকে বলেছিলেন,
-আমি দেখতে পাচ্ছি মেহুল তোমার মনের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে আছে একটা দরদী সত্ত্বা। দারিদ্র, অসহায়তা যাকে কষ্ট দেয়। তাই জন্যে তুমি নিজেকে এসব থেকে দূরে রাখতে চাও, পালিয়ে যেতে চাও। কিন্তু বারবার তারা ফিরে আসে তোমার অবচেতনে। পালিও না। তাদের কাছে যাও। তাদের সঙ্গে মিলিয়ে দাও নিজের জীবনকে। দেখবে তাদের অসহায়তার সামনে তোমার না পাওয়াগুলোকে কতটা তুচ্ছ মনে হবে।
চেন্নাই থেকে ফিরে এসে মেহুল যোগ দিয়েছে শহরের নামকরা এন.জি.ও ‘আত্মজন’-এ। কাজ করছে শহরের বস্তিবাসী ছেলেমেয়ে আর পথশিশুদের নিয়ে। ভু্লে থাকার চেষ্টা করছে তার মনের মাঝে জমাট বেঁধে থাকা কষ্টটাকে।
আজ স্বাধীনতা দিবসে তাদের ঠাঁসা কর্মসূচী। সকালে সংস্থার দপ্তরে পতাকা উত্তোলনের পর তারা যাবে সদর হাসপাতালে। দুঃস্থ রোগীদের বিতরণ করবে পুষ্টিকর খাবার। তারপর সন্ধেবেলায় আছে সুর্যনগর কলোনির কচিকাঁচাদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
লালা পাড়ের সবুজ তাঁতের শাড়ি পড়েছে মেহুল। সঙ্গে হালকা গয়না। কপালে বড় লাল টিপ। ঠিক যেন এক বাঙালি মা-এর প্রতিরূপ। সদর হাসপাতালে পরপর ওয়ার্ড ঘুরে সে আর তার সহযোগীরা পেশেন্টদের হাতে তুলে দিচ্ছে ফল, হেলথ ড্রিংক, ড্রাই ফ্রুট ইত্যাদি। হাসিতে ভরে উঠছে মানুষগুলোর মুখ। মন ভরে আশীর্বাদ করছেন মেহুলদের।
কয়েকটা ওয়ার্ড ঘুরে শেষে তারা পৌঁছাল লেবার ওয়ার্ডে। কিছু একটা যেন খুঁজছে মেহুল। তাকে দেখে হাসিমুখে একজন নার্স এগিয়ে এলেন। কোলে একটা ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা। দু-তিন দিনের হবে। পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। তার সামনে এসে নার্স বললেন,
-এই যে নিয়ে এসেছি। একেই খুঁজছিলেন তো আপনি?
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর মাখা চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল মেহুল। তারপর নার্সকে বলল,
-সিস্টার ওর মা এখন কোথায়?
সিস্টার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
-এখানেই আছে এখনও। আজ শিফট করা হবে। ওই তো ওদিকটায় দেখুন না।
সিস্টার যেদিকে দেখালেন সেদিকে মুখ তুলে তাকাল মেহুল। হাসপাতালের হালকা নীল পোশাকে তাকে বেশ মানিয়েছে। পরিপাটি করে কোঁকড়ানো খয়েরি চুলগুলো পেছনে বাঁধা। সেই ভবঘুরে, নগ্ন মেয়েটাকে আজ আর অন্য পাঁচটা সদ্য মা হওয়া মেয়ের থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না।
সাধারণ বেডগুলোর থেকে একটু তফাতে জানালার ধারে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিজের খেয়ালেই মেতে আছে সে। আপনমনে জানলা দিয়ে চুঁইয়ে আসা রোদকে আঁজলা পেতে ধরার চেষ্টা করছে। তারপর দু’হাত নাকের কাছে এনে বুক ভরে নিচ্ছে আলোর ঘ্রাণ।
Read More: রবিবারের ছোটগল্প টার্গেট লিখেছেন বৈশাখী ঠাকুর