ছোটগল্প
লালপরী
রু না তা স মি না
ছবি: প্রীতি দেব
ইস! ভিজিয়ে দিলেতো আমাকে! তুমি পচা!
কে বললো! চমকে উঠল টুকুন। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, কই? কেউ নেই তো! তাহলে কে আমাকে বকা দিল!
এই যে, আমি এখানে! গোলাপ গাছের নীচে।
টুকুন তাকিয়ে দেখলো ছোট্ট পুতুলের মতো একটি মেয়ে! লাল জামা পরা। এত ছোট মানুষ টুকুন আগে কখনো দেখেনি। তাই বিস্ফারিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি বেরিয়ে এসে টুকুনের সামনে দাঁড়াল।
এই দ্যাখো। তুমি আমার জামাটা কেমন করে ভিজিয়ে দিলে? তুমি কি পানি ঢালার আর সময় পেলে না? কোথায় একটু ফুলের সুগন্ধে ঘুমুবো- তুমি আমার ঘুমটাই নষ্ট করে দিলে! তোমরা ,মানুষগুলো না বেশি পচা! এত সুন্দর বাগানকে কি করে রেখেছ! কাগজ,চকলেটের খালি খোসা,চিপসের খালি প্যাকেট কি ফেলোনি! আর রাস্তা-ঘাটের কথা তো আর বললামই না। এতো ময়লা কেউ ছড়িয়ে রাখে ! নিজের দেশে?
ভয় পাওয়া দুরের কথা। এত্তগুলো বকা খেয়ে টুকুন গেলো সাংঘাতিক রেগে!
তুমি কে গো? দেখতে এত্তটুকুন! আমার বাগানে ,আমার গোলাপ গাছে চড়ে আমাকেই বকে যাচ্ছ? এই পিচ্চি মেয়ে, কি নাম তোমার? এসেছ কোথা থেকে আমার বাগানে?
পিচ্চি মেয়ে ডাকো আমায় তুমি! এত্তোবড় সাহস! দাঁড়াও আমি তোমার সমান হচ্ছি এখনি! বলতে বলতে সে বড় হচ্ছিল।
টুকুন অবাক হয়ে দেখতে লাগলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে মেয়েটি ওর সমান হয়ে গেলো!
আমি লালপরী। তোমাদের এই বাগানটি আমার খুব পছন্দ। তাই আমি প্রতিদিন পরীর দেশ থেকে এখানে ঘুরতে আসি। কিন্তু এখানে আর থাকা যাবেনা। পাশের ডাষ্টবিন থেকে এত বিশ্রী দুর্গন্ধ আসে ,থাকা মুশকিল! লালপরী নিজমনেই বলে যেতে লাগলো। বইয়ে টুকুন পরীর গল্প অনেক পড়েছে। বইয়ে পরীদের কথা পড়ার সময় মনে হতো তার যদি একটি পরীবন্ধু থাকত! আজ সত্যি সত্যি পরী দেখে টুকুন একটুও ভয় পেলনা। কিন্তু এ পরীটা ভারী ঝগড়াটে! সে কি টুকুনের বন্ধু হবে!
এই মেয়ে ! এখন কেন চুপ করে আছ?
তার কথা শুনে টুকুনের মেজাজ গেলো আরো বিগড়ে।
কি ঝগড়াটে পরী তুমি! বইয়ের পরীরা তো তোমার মতো ঝগড়াটে হয় না। আমি বইয়ের পরীদের কত ভালোবাসতাম! আর তুমি আমাকে শুধু বকেই যাচ্ছ। বলেই টুকুন কান্না করে দিল।
আরও পড়ুন: রবিবারের ছোটগল্প অবসাদের দাওয়াই লিখেছেন শর্মিষ্ঠা দত্ত ।
টুকুনের কান্না দেখে লালপরী এবার সুর নরম করে বললো,কান্না করোনা গো। কারো কান্না দেখলে আমারও কান্না পায়। চলো আমরা ভাব করে নিই! তোমার নাম কি?
চোখের পানি মুছতে মুছতে টুকুন নাম বললো। বাহ! ভারী সুন্দর নাম তো তোমার! যত্ন করে লালপরী টুকুনের চোখের পানি মুছিয়ে দিল। চলো আমরা বেড়িয়ে আসি।
কিভাবে যাবো আম্মুকে ছাড়া? আমি তো কিছুই চিনি না। আর আম্মুকে না বলে কোথাও গেলে আম্মু বকবে। টুকুন বললো।
তুমি কিচ্ছু ভেবো ন। আমরা উড়ে উড়ে বেড়াবো আর কিছু এমন কাজ করবো, আম্মু বকা দেয়ার বদলে খুশিই হবে। লালপরী মিষ্টি হেসে বললো।
আমরা উড়ব! আমি কিভাবে! তুমি পরী ,তাই তুমি উড়তে পারবে। কিন্তু আমি কিভাবে!
লালপরী কি যেন বিড়বিড় করলো। ওমা! টুকুনের পেছনেও ফিনফিনে দুটো পাখা গজিয়ে গেলো! বিস্ময়ে টুকুনের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার যোগাড়! টুকুন দু’হাত মেলে একটু নাড়াতেই আশচর্য হয়ে দেখল,ওর পা দুটো মাটি থেকে উপরে ঊঠে যাচ্ছে। দারুন মজা লাগছে তো! লালপরীর পেছনেও দুটো পাখা। টুকুনের হাত ধরে লালপরী বললো, চলো,আগে আমরা তোমাদের বাগানটিই ঘুরে দেখি। হাওয়ায় ভেসে উড়ে উড়ে বেড়াতে টুকুনের খুব মজা লাগছে।
তুমি খু-উ-ব ভালো বন্ধু। খুশি হয়ে টুকুন লালপরীকে বললো।
এবার বাগান থেকে বেরিয়ে দু’জন বেরিয়ে পড়লো শহর দেখতে। টুকুন অবাক হয়ে দেখলো,লালপরী মিথ্যে বলেনি। এমনিতে বোঝা যায়না কিন্তু উপর থেকে দেখা যাচ্ছে কি নোংরা হয়ে আছে সবদিক! এ মা! এত নোংরা চারিদিকে! বাচ্চারা তো আছেই, বড়রাও একটুও খেয়াল রাখছে না পরিচ্ছন্নতার দিকে! এবার টুকুন বুঝতে পারল, লালপরী কেন এত বিরক্ত মানুষের দেশের উপর। লালপরী না নিয়ে এলে টুকুনের এসব কখনো দেখাই হতোনা।
এবার চলো, আরেকটি জায়গায় তোমাকে নিয়ে যাই। রহস্যময় হাসি হেসে লালপরী বললো, কিন্তু আমি না বলা পর্যন্ত তুমি চোখ বন্ধ রাখবে। প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে টুকুনের খুব মজা লাগছিল। তাই লালপরীর কথায় আর আপত্তি করলো না। অল্পক্ষণ পরেই লালপরী টুকুনকে বললো চোখ খুলতে। টুকুন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এত সুন্দর চারিদিক! ছবির মতো যেন সবকিছু। কোথাও একফোঁটা ময়লা-আবর্জনা নেই। কতরকমের সুন্দর ফুল বাতাসে দুলছে। কেউ একটি ফুলও ছিঁড়ে নিচ্ছেনা। সবাই কি নিয়ম করে চলছে! বাচ্চারা কি হাসি-খুশি! কোথায় নিয়ে এলো লালপরী তাকে!
কি? খুব আশ্চর্য হচ্ছো? এ হচ্ছে পরীর দেশ। এখানে হিংসা,বিদ্বেষ,মারামারি কিছুই নেই। এখানে সবাই সবার অনেক প্রিয়।
টুকুন ভাবে,ইস! এরা কত্তো ভালো!
চলো এবার ফিরে যাই। আমাদের একটি কাজ করার কথা। তবে এখন তুমি ঘরে ফিরে যাবে। সম্বিত ফিরে পায় টুকুন লালপরীর কথায়।
জিজ্ঞেস করে,তাহলে কাজটি আমরা কখন করবো?
বোকা! দিনের আলোতে কিভাবে করব! রাতে যখন আমরা কাজ শুরু করবো চুপি চুপি তোমাকে ডেকে নেবো।
লালপরীর কোথায় রাজি হয়ে টুকুন মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলে, চলো।
রাতের অন্ধকারে শুরু হয় ওদের সেই কাজ। এবার লালপরী একা আসেনা। নীলপরী, ফুলপরী, হলুদপরী সবাই দল বেঁধে আসে। জানালা দিয়ে টুকুনকে ডেকে নেয়। সবাই মিলে টুকুনের শহরকে ঝকঝকে,তকতকে করে তোলে। সবকাজ শেষে ফিরে আসে সবাই আবার টুকুনের বাগানে। বাগানের পাশের ময়লার স্তুপগুলো মুহুর্তেই কোথায় গায়েব হয়ে যায়। টুকুন দেখে লালপরী আর তার বন্ধুরা কি সুন্দর করে তুলেছে তাদের বাগান,বাড়ির চারপাশ। বিদায় নেয়ার সময় লালপরী বলে যায়, এখন আমরা সবাই মিলে তোমার বাগানে প্রত্যেকদিন আসবো। টুকুন ঘরে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে জেগেই শোনে, মা অবাক হয়ে বাবাকে বলছে-কে করলো এই কাজ! দেখো বাড়ীর চারপাশ কেমন ঝকঝক করছে! এখন থেকে আমাদের আরো খেয়াল রাখতে হবে। চারিদিকে সবাই বলাবলি করছে, কে করলো এই কাজ! পত্রিকায় বড় করে খবর বেরোয়,যারা পুরু শহরকে এত সুন্দর করে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন করে তুলেছে সরকার তাদের পুরস্কার দেবেন। আর টুকুন খবর পড়ে মিটিমিটি হাসে।
আরও পড়ুন: রবিবারের ছোটগল্প রং-বাজি লিখেছেন কৃষ্ণেন্দু পালিত