ছোটগল্প
পরিচয়
সুদীপ্ত রায়
Illustration: Preety Deb
এক.
অফিস থেকে ফোনটা আসার সাথে সাথে সুকান্তর মনে আনন্দ বিষাদ একসাথে খেলে গেল। এবং একই সাথে বেশ কিছু চিন্তা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো, তার মনে হল আবার নতুন করে মানিয়ে নেওয়া, এতগুলো বছর তো সে বাড়ির বাইরে বাইরেই আছে। এবার একটা সুযোগ ছিল নিজের শহরে পোস্টিং নেওয়ার, রিলেশনশিপটা ভেঙে যাবার পর সে মনে মনে ভীষণ ভাবে চেয়েছিল নিজের শহরে ফিরে যেতে, কারণ অফিস ফেরার পর একলা সময়টা তাকে ভীষণ কষ্ট দেয়, দেয়ালগুলো যেন গিলে খেতে আসে। এতদিন সুরঞ্জনার সাথে ফোনে কথা বলেই তার অফিসের সারা দিনের খাটনির ক্লান্তি দূর হয়ে যেত, তারা ঠিক করেছিল এক বছরের মধ্যে বিয়ে করবে, কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে গেল, শুধুমাত্র সে প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে বলে সুরঞ্জনার বাড়িতে আপত্তি ছিল, কিন্তু বাড়ির অমতেও তাদের সম্পর্ক এগিয়ে চলেছিল বেশ, তার চাকরী নিয়ে সুরঞ্জনার তো কোনো আপত্তি ছিল না, তাহলে সে কি করে অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি হলো? এইসব ভেবে সুকান্ত কুল পায় না, সকালটা অফিসে কাজের মধ্যে কেটে যায়, কিন্তু সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই সমস্ত কষ্ট দুঃখগুলো যেন তাকে একলা পেয়ে দেওয়ালের আনাচ কানাচ থেকে বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে, তাই সে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে নতুন চাকরীর জন্য ইন্টারভিউটা দিয়েছিল, দুটো শহরের জন্য পোস্ট খালি তার মধ্যে একটা তার হোমটাউন ও রয়েছে, কিন্তু সেটা আর হলো না। তবে মন্দের ভালো এবার যেখানে হয়েছে সেখানে সে নিজের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটা বছর কাটিয়েছে। নিজের মনে বিড় বিড় করতে করতে সুকান্ত সিগারেট ধরালো। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন চারদিনের মধ্যে শান্তিনিকেতনের অফিসে গিয়ে রিপোর্টিং করতে হবে, এত তাড়াতাড়ি থাকার জায়গা ঠিক করা, জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া, জয়েনিং ডকুমেন্টস রেডি করা কি করে কি করবে কিছুতেই ভেবে না পেয়ে আনমনে পকেট থেকে মোবাইলফোন বার করে সে পুরনো কনট্যাকটসগুলো সব ঘাটতে লাগলো, একদুজন ইউনির্ভাসিটির বন্ধু যারা এখনো আছে ওখানে তাদের ভাবলো ফোন করবে, আবার পরক্ষণেই তার মনে হল ধূর এত তাড়াহুড়ো করার কি আছে? আজকের সকালটা পেরোক, বাড়ি ফিরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে একটা ভালো করে ভাত ঘুম দিয়ে তারপর না হয় এসব নিয়ে ভাবা যাবে।
আমেরিকার চার বছরের সুপার হিরো খেলনার টাকা দিয়ে গরিবের খাবার কেনে
দুই.
দেখতে দেখতে মাঝের তিনটে দিন পেরিয়ে তার যাবার দিন নিকটে এলো। এরইমধ্যে সুকান্ত কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করে উঠতে পেরেছে। থাকার জায়গা নিয়েও একজনের সাথে প্রাথমিক কথা হয়েছে। তার পুরনো বন্ধুদের মধ্যেই একজন অমিত তাকে বাড়িওয়ালার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে। বাড়িওয়ালা সুকান্তকে জানিয়েছেন খাট একটা দেওয়াল আলমারি রুমের মধ্যেই আছে তাই সেগুলো নতুন করে নিয়ে আসার বা জোগাড় করার কোনো প্রয়োজন নেই, এর বাইরে অন্য কোনো আসবাবের প্রয়োজন হলে শুধুমাত্র সেগুলো যেন সে নিয়ে আসে। তার কথা শুনে সুকান্ত মনে মনে হেসে বলেছে একটা খাট, আলমারি আর মুখ দেখার জন্য একটা আয়না এই তার একার সংসারের জন্য যথেষ্ট। আর সে এও ঠিক করেছে শান্তিনিকেতন থেকে যেহেতু তার নিজের শহর আসানসোলের দূরত্ব খুব বেশি নয় তাই ছুটির দিন শনি রবি নিজের বাড়িতেই পরিবারের সাথে কাটাবে। তাতে দীর্ঘদিন বাড়ীর বাইরে থাকার একাকীত্বও কিছুটা দূর হবে।
তিন.
নতুন অফিসে জয়েনিং এর দিন সুকান্ত একটু বেশী সকালেই পৌঁছে গেল শান্তিনিকেতনে, অফিস খুলতে তখনো ঢের দেরি। তাই সে প্রথমেই বাড়ি দেখার জন্য চলে যায়, বাড়িওয়ালার সাথে আগেই কথা হয়েছিল ফলে একবার পরিচয় দিতেই যে সাদরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। বাড়িটা অফিসের কাছেই এবং বেশ ছিমছাম, মালিক বিজন বাবুও বেশ সজ্জন ব্যক্তি। ফলে সব মিলিয়ে সুকান্তর বেশ পছন্দ হয়, সাথে উপরি পাওনা হয় বিজন বাবুর কিছু উপদেশ এবং বরাভয়। বিজন বাবু তাকে বলে, “তুমি আমার ছেলের মত এই,বাড়িতে থাকবে ।কখনো কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বা তোমার কাকিমাকে জানাবে। কক্ষনো মনে করবে না যে তুমি এখানে একলা আছো। আর দেখছো তো এখন দিনকাল ভালো নয়, তাই রাতে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা কোরো”। শুধু শেষ কথাটি সুকান্তর একটু অপছন্দ হয়। কারণ সে এরই মধ্যে প্ল্যান করে রেখেছে অফিস শেষে পুরনো বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেবে। আহা শান্তিনিকেতনে চায়ের দোকানে আড্ডা!! কলেজ ইউনির্ভাসিটি ছেড়ে যাওয়ার পরের পাঁচ ছয় বছর যার স্বাদ থেকে সে বঞ্চিত। সে বিজনবাবুর হাত ধরে আস্বস্ত করে বলে, “কাকু ওসব নিয়ে একদম ভাববেন না, আমি এখানে পড়াশোনা করেছি, ফলে পথঘাট, মানুষজন, সংস্কৃতি কোনোটাই আমার কাছে নতুন নয়। বেশ কয়েকজন বন্ধু বান্ধব ও আছে, ফলে আশা করছি কোনো অসুবিধা হবে না। তবে আপনি এতো সাহায্য করলেন আমকে, সবকিছুর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আর হ্যাঁ সেরকম কিছু প্রয়োজন হলে নিশ্চয় আপনাকে জানাবো”। এই বলেই সে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই, সে বলে, “এখন তবে উঠি, দুপুরের দিকে ফিরবো। অফিস আজ আধবেলার ছুটি মঞ্জুর করেছে বাড়ির গোছগাছ সম্পূর্ণ করার জন্য”। বিজনবাবু সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ে। সুকান্ত হাঁটা দেয় অফিসের দিকে, মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। ফলে সে দশটা পনেরোর রিপোর্টিং টাইমের আগেই অফিস পৌঁছে যায়। অফিসে পৌঁছেই সে আকাশ থেকে পড়ে, হেড অফিসে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে এবং সেখানে লোকজনের মুখে বিবরণ শুনে নতুন অফিসের যা চিত্র তার মনের মধ্যে তৈরি হয়েছিল তা এক আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সে কিছুতেই ভেবে পায় না একটা কর্পোরেট সংস্থার অফিস কি করে এরকম হতে পারে, এই অফিস কে যে কেউ বড় দোকানের গুদামঘর বলে চালিয়ে দিতে পারে। মুহূর্তের জন্য তার মনে হয় এর চেয়ে তার আগের অফিস অনেক ভালো ছিল,একবার সে ভাবে এক্ষুনি রেজিগনেশন দিয়ে অন্য চাকরির খোঁজ করবে। বাড়িতে ফোন করে সব কথা জানাতেই সুকান্তর বাবা বলে চরম কিছু সিদ্ধান্ত নেবার আগে অন্তত একটা মাস যেন সে অপেক্ষা করে, প্রথম দিনেই কোন সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না। বাড়ির ফোন রাখতেই সুকান্তর মোবাইল আবার বেজে ওঠে, স্ক্রিনে ভেসে ওঠে হেড অফিসের অফিসের নাম্বার। ফোন রিসিভ করতেই ওপ্রান্ত থেকে গলা ভেসে আসে, “শুনলাম তুমি পৌঁছে গেছ। স্বাগত তোমাকে। অফিসটা দেখে হয়তো তোমার একটু মন খারাপ হয়েছে, তবে ও কিছু না। তুমি এডমিন ইনচার্জ মানে তুমিই ওই ব্রাঞ্চের বস, তোমাকেই দায়িত্ব নিয়ে সব একটু গুছিয়ে নিতে হবে”। এতদূর বলে অনিমেষ বাবু জিজ্ঞাসা করে, “তা বলছি বাড়ির ব্যবস্থা তো শুনলাম হয়ে গেছে, থাকার জায়গাটাও একটু গুছিয়ে নিও, আর আফিসে সারাদিন কি হচ্ছে সব জানিয়ে আমাকে দিনের শেষে আপডেট দিও”। সুকান্ত সবটা শোনার পর শুধু বলে “হ্যাঁ” অনিমেষবাবু ফোন রেখে দেয়। অফিসে প্রাথমিক কিছু কাজ সেরে সে বাড়ি ফিরে আসে। বিজন বাবু ইতিমধ্যেই লোক দিয়ে বাড়ি পরিস্কার পরিছন্ন করে আসবাবপত্র গুলো সাজিয়ে রেখেছিলো, ফলে সুকান্তকে বিশেষ কিছু করতে হয়নি। তবু অল্প যেটুকু বাকি ছিল তাতে অমিত হাত লাগালো তার সাথে। ঘর গোছানো শেষ হতেই অমিত জিজ্ঞাসা করে, “বিকালে কি করছিস?” সুকান্ত বলে, “তেমন কিছুই তো কাজ নেই বিকালে, তুই যদি ফ্রি থাকিস তো একটু সোনাঝুরির দিকে যাব”। অমিত বলে, “নো প্রবলেম, তাহলে চল এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি, একটু তাড়াতাড়ি ফিরে মেলা মাঠে মাঠের দিকে যাব।” একটু বিষ্মিত হয়ে সুকান্ত জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাঁ সে যাওয়াই যায়,কিন্তু তার জন্য তাড়াতাড়ি ফেরার কি দরকার? আজ কি বিশেষ কিছু আছে নাকি?” অমিত হেসে উত্তর দেয়, “সব ভুলে গেছিস তুই আজ ২২ শে ডিসেম্বর মানে বাংলা ছয় পৌষ, কাল থেকে পৌষ উৎসব, আজ তো মেলা প্রাঙ্গনে সব ডিপার্টমেন্টের স্টলগুলো সাজানো হয়, আমি কিন্তু পাশ করে বেরিয়ে যাবার এতো বছর পরও এই একটা দিন ডিপার্টমেন্টের কাজে যায়। স্যর ম্যামেদের সাথে কথা হয়, নতুন ছেলে মেয়েরা যারা পড়াশোনা করতে এসেছে তাদের সাথে আলাপচারিতা হয়, সাধ্যমত স্টল সাজানোর কাজে তাদের সাহায্য করি। কেন জানি না মাঝেমধ্যে মনে হয় যে কিছুই বদলায় নি, সব আগের মতই আছে। তোরাও যেন আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছিস। চল না আজ একবার, ভীষণ ভালো লাগবে”। সুকান্ত মাথা নেড়ে উত্তর দেয়, “বেশ, যাবো ক্ষণ”।
চার.
সোনাঝুরি পৌঁছে সুকান্ত দেখে জায়গাটা আর আগের মত নেই। বেশ কিছু বদল চোখে পড়ে তার। রাঙা মাটির রাস্তাটাও পিচ রাস্তায় বদলে গেছে। কিছুতেই সে বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। এই শান্তিনিকেতন যেন তার কাছে ভীষণ অচেনা। সে মনে মনে স্থির করে, আর দেরি না করে কাল থেকেই সে নতুন চাকরি খোঁজার কাজে নেমে পড়বে। এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সময় কত গড়িয়েছে তাদের খেয়াল ছিল না। হঠাৎ অমিত ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে পাঁচটা বাজতে আর দেরি নেই, খোয়াইয়ের বনে কিছুটা আঁধার নেমেছে। “চল এবার যাওয়া যাক।” বলে সুকান্তর পিঠে টোকা দেয়। সেও সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে তার গাড়িতে চেপে বসে। পৌষ মেলার আগের দিন বলে রাস্তায় ভীড় বেশ কিছুটা বেশি, ফলে অল্প পথ পেরোতেও তাদের কিছুটা বেশি সময় লাগে। দেশ বিদেশ থেকে মানুষ তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে এসেছে, তারই মধ্যে বেশ সুন্দর করে সাজানো একটা জায়গায় পাশাপাশি বিশ্বভারতীর সব ডিপার্টমেন্টের স্টল, ছাত্র ছাত্রীরা মনের আনন্দে কাজ করে চলেছে, কেউ কেউ আবার মোবাইলে ব্যস্ত, সোস্যাল নেটওয়ার্কিং-এর যুগে কখনো সামনাসামনি দেখা না হওয়া মানুষের সাথেও পরিচিতি বেরিয়ে যায়। সুকান্তর সাথেও তার ব্যতিক্রম হলো না। অমিত আবার বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ ও করিয়ে দিলো। এতক্ষণ বেশ মনমরা হয়ে থাকলেও ভুবনডাঙার মাঠ যেন তার মনে একঝলক টাটকা বাতাস বয়ে নিয়ে এলো। অমিতের মত তারও মনে হলো কিছুই যেন বদলায়নি। নতুন আলাপ হওয়া জুনিয়ারদের সাথে সুকান্ত আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়। সেই দলেই ছিল চারুলতা। বন্ধুরা তাকে চারু বলেই ডাকে, প্রাচীন রাজপুত রমণী দের মতো সৌন্ধ্রর্যের কারণে সে ভিড়ের মধ্যেও দৃষ্টি-আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। সুকান্তর যেন চোখ আটকে যায়, এবং চোখাচোখি হতেই চোখ ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চারু হেসে ফেললে সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বিষয়টা হালকা করার জন্য চারু জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কি থিয়েটার করো?”
-কেন বলো তো?
-তোমার গলা শুনে মনে হলো।
-আগে করতাম, এখন কাজের চাপে আর হয়ে সেরকম হয়ে ওঠে না, তবে…
সুকান্ত আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, চারু তাকে থামিয়ে বলে, “আমি নিজে কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় প্রায়শই নাটক দেখতে চলে যেতাম, এখনে চলে আসার পর কতদিন যে যাওয়া হয়নি”।
-কেন এখানেও তো, নাট্যঘর, লিপিকাতে থিয়েটার ফেস্টিভাল হয়।
-তা হয়, তবে মনের মতো সাথি না পেলে নাটক দেখতে যেতে ভালো লাগে না।
-সে বিষয়ে আমিও একমত।
নানাবিধ আলোচনায়, তাদের গল্প বেশ জমে ওঠে। অনেকদিন পরে সুকান্তকেও যেন আজ কথায় পেয়েছে। কতদিন ভালো করে সে আড্ডা দেয়নি, বুকের মধ্যে একটা চাপা উদ্বেগকে বহুদিন ধরে সে বয়ে নিয়ে চলেছে। আজ যেন প্রথম আলাপ হওয়া মেয়েটির কাছে তার নিজেকে মেলে ধরতে ভীষন ইচ্ছা হোল। অদ্ভূত এই পৃথিবী অনেক চেনা মানুষ কে সময় সময় অচেনা লাগে, আবার অনেক অচেনা মানুষ কেও প্রথম আলাপেই ভীষণ পরিচিত মনে হয়।
তাদের আলাপচারিতায় ছেদ পড়ল অমিতের গলা ঝাড়ার শব্দে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে সুকান্ত বলে, “আরে তোকেই খুঁজছিলাম, কোথায় চলে গেছিলি এতক্ষণ?” উত্তরে অর্থবহ হাসি হেসে অমিত বলে, “পাঁপড় ভাজা খেতে, তা বলছি বৈতালিকের সময় হয়ে এলো একটু গৌরপ্রাঙ্গনের দিকে গেলে কেমন হয়?”
“খুব ভালো” চারু উত্তর দেয়।
তারা সকলে পা-বাড়ালো গৌরপ্রাঙ্গনের দিকে, প্রায় গোটা রাস্তা চারু আর সুকান্ত পাশাপাশি হাঁটে, অন্যদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে। মাঝে অমিতের সরস উক্তি শোনা যায়, “আমরাও কিন্তু আছি!”
সুকান্তর মন আজ খুশিতে ভরে উঠেছে, অনেকদিন পরে আজ তার নিজেকে ভীষণ ভারমুক্ত লাগছে, আলো আঁধারি পথে সে গুণ গুণ করছিল তার প্রিয় একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত।
বৈতালিক থেকে বাড়ি ফিরে মোবাইল ডেটা অন করতেই সে দেখে অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ, “আমি চারু, আর এইটা আমার হোয়াটস অ্যাপ নাম্বার, সেভ করে নিও। আর হ্যাঁ গানটা ভীষণ সুন্দর ছিল, যদিও সব কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম না, শোনার ইচ্ছা রইলো”। সুকান্ত উত্তরে লেখে, “কাল বিকেলে মেলা মাঠে দেখা হচ্ছে, আমি সেন্ট্রাল অফিসের সামনে এসে কল করবো সাথে কয়েকটা ইমোজি”।
সামনের দিনগুলোতে সুকান্তর জীবনে চারু দখল নেয়। পৌষ উৎসব শেষ হয়ে যাবার পর শান্তিনিকেতনে মানুষজনের ভীড় কমে আসে। আলো আঁধারী পথ তাদের আরো কাছে নিয়ে আসে। তার প্রতিদিনের অফিসের ক্লান্তি যেন চারুর দেখা পেলেই নিমেষে উবে যায়, “রেজিগনেশন দিয়ে দেবার চিন্তা!” সে আর ওসব মাথাতেই আনতে চায় না। তার জীবনে যেন নতুন পরিচয়ে ফিরে এসেছে পূর্বপল্লীর পথ, ভুবনডাঙার মাঠ, সোনাঝুরীর বন আর কোপাই।
তার বাবাও দেখে সুকান্তর আর অফিস সম্পর্কিত কোন অভিযোগ নেই।সপ্তাহ শেষে বাড়ি ফিরলে তিনি গর্বের সুরে বলেন, “বলেছিলাম না চরম সিদ্ধান্ত নেবার আগে অন্তত একটা মাস অপেক্ষা করতে। সব ঠিক হয়ে যাবে। অভিজ্ঞতার একটা দাম তো আছেই নাকি…”।
Read More: ধারাবাহিক উপন্যাস খাতা লিখেছেন দেবশ্রী চক্রবর্তী