Home / রবিবারের আড্ডা / গল্প / রবিবারের ছোটগল্প রং-বাজি লিখেছেন কৃষ্ণেন্দু পালিত

রবিবারের ছোটগল্প রং-বাজি লিখেছেন কৃষ্ণেন্দু পালিত

ছোটগল্প

রং-বাজি

কৃ ষ্ণে ন্দু পা লি ত

ছোটগল্প

ছবি: প্রীতি দেব


ইদানীং মাথা ব্যথাটা বেড়েছে। আগে মাসে দু-একবার হত। এখন সপ্তাহে দু-তিন দিন। পেইন কিলার খেয়েও কাজ হয় না। কাটা ছাগলের মত ছটফট করি। বুঝলাম আর উপায় নেই। ‘মাথা থাকলে মাথা ব্যথা হবে’ এই নীতিবাক্য মানলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে। শহরের নাম করা ফিজিসিয়ানের কাছে গেলাম। সাইত্রিশটা প্রশ্নের উত্তর জেনে দুরকম ওষুধ লিখলেন। দিনে দুবার। একটা খাওয়ার আগে, একটা পরে। এক সপ্তাহের ওষুধ। না কমলে স্ক্যান করাতে হবে।
বাড়ি ফিরে বউকে সব জানালাম। বউ বলল, ওষুধগুলো দেখি। কম্পোজিশন না দেখে বউ কোন ওষুধ খায় না, আমাকেও খেতে দেয় না। আমি ওসব বুঝি না। কখনও বোঝার চেষ্টা করিনি।
কম্পোজিশন দেখা হলে বউ দুরকম দুটো ওষুধের মোড়ক খুলল। একটার রং লাল, আর একটা নীল। নীলটা খাওয়ার আগে, লালটা পরে।
বউ বলল, অসম্ভব। আগে লাল।
আমি বললাম, ওষুধের গুনে পরিচয়। রঙে কী এসে যায়!
বউ মুখ ঝামটা দিল, মাথায় কিচ্ছু নেই। যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বলো না। এই জন্যেই জীবনে উন্নতি করতে পারলে না। অন্য ডাক্তারের কাছে যাও।
প্যাকেট ধরে ওষুধগুলো সে নর্দমায় ফেলে দিল।
আমি শান্তশিষ্ট পত্নীনিষ্ঠ গোবেচারা ভদ্রলোক। হোম মিনিস্টারকে চটানোর সাহস নেই। বউ বিগড়ে গেলে জীবনের শান্তি চটকে যাবে। বউ ঠিক থাকলে দুনিয়া ঠিক। চোখ কান নাক মুখ কিডনি লিভার হার্ট ফুসফুস দিন রাত হাগা মোতা… সব। কাজেই আমি অন্য ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনিও দুরকম ট্যাবলেট দিলেন। একটা খাওয়ার আগে, একটা পরে।
বউ মোড়ক খুলল। একটা গোলাপি অন্যটা সবুজ। সবুজটা খাওয়ার আগে।
বউ বলল, কভি নেহি। সবুজ কোনো ভাবেই না।
আবার ডাক্তার পরিবর্তন। একগাদা টাকা গচ্চা। তা হোক, সবার উপরে বউ সত্য। তবু রঙ মিলল না ওষুধের। বাড়ি ফিরে ছুঁড়ে ফেললাম নর্দমায়।
বউ বলল, সব বাজে ডাক্তার। টুকে পাশ করেছে। ভালো ডাক্তার খোঁজো, যতদিন না পাও কপালে বাম লাগিয়ে দেব। মাথা টিপে দেব।
এবার আর রোগ নয়, ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওষুধের রঙের কথা বললাম। বউয়ের কথা বললাম।
ডাক্তার বলল, বউকে নিয়ে মাথার ডাক্তারের কাছে যান।
বউকে একথা বলার সাহস আমার নেই। ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া দুরের কথা। ডাক্তারের বয়স কম, নতুন পাশ করেছে, তাই বাস্তববুদ্ধিও কম। তার পরামর্শ শুনলে আমার বিপদ আরও বাড়বে। বুঝলাম আমার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। পারলে বাঁচব, না পারলে না। অফিসের কলিগ থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব পাড়া-প্রতিবেশী যার সাথেই দেখা হয় তাকেই আমার সমস্যার কথা বলি। কেউ বলে, এটা কোন চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। কেউ বলে, রঙ বেছে ওষুধ দেবে তেমন কোন ডাক্তার আমার জানা নেই। কেউ বলে, আগে ঠিক করুন সমস্যাটা আপনার না ওষুধের, তারপর ডাক্তার খুঁজবেন।
সবাই কোনও না কোনও অজুহাতে এড়িয়ে যায়।
কেবল হরিপদ, আমার ছোটবেলার বন্ধু, বহু বছর বাদে তার সাথে রাস্তায় দেখা, সেই কেবল আশার আলো দেখাল। বলল, খোঁজ নিয়ে দেখি। পেলে জানাব।
-তাড়াতাড়ি জানাস ভাই। দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অকালে মারা যাব।
হরিপদ সপ্তাখানিকের মধ্যে জানানোর প্রতিশ্রুতি দিল।
এক সপ্তা নয়, দশ দিনের মাথায় হরিপদকে ফোন করলাম, কীরে কোন খবর পেলি?
-এখনও পাইনি। পেলে জানাব।
সপ্তাখানেক বাদে আবার ফোন করলাম। হরিপদ এবার বিরক্ত হল, তোকে তো বলেছি, পেলে জানাব। ফোন করার দরকার নেই।
হরিপদ ফোন কেটে দিল।
মাথা যন্ত্রণা আমার, তাগিদও আমার। বারণ করা সত্ত্বেও তাই কিছুদিন বাদে ফোন করলাম। রিং হয়ে গেল। কেউ ধরল না।
দুদিন বাদে আবার করলাম। সেদিনও রিং হয়ে গেল। বুঝলাম হরিপদ আমার ফোন আর কোনওদিন ধরবে না।

বছরখানেক কেটে গেল গিন্নির পছন্দমতো ডাক্তার খুঁজতে। যত দিন যাচ্ছে, আমার অবস্থা শোচনীয় হচ্ছে। মাথার যন্ত্রণা এখন চব্বিশ ঘণ্টার ব্যামো। সুস্থ ভাবে কিছু ভাবতে পারি না, করতে পারি না। কেমন যেন পাগল পাগল লাগে। ভালো কথা শুনলেও রাগ হয়। খাবার দেখলে গা গোলায়। কাউকে হাস্তে দেখলে কেঁদে ফেলি। কেবল গিন্নিকে কিছু বলতে পারি না। যম আর বউয়ে কোন পার্থক্য নেই। বউয়ের মুখ দেখতেও ইচ্ছে করে না। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। ছায়া দেখলে বসি, শোয়ার জায়গা পেলে ঘুমোই। কোনও দিন বাড়ি ফিরি, কোনও দিন ফিরি না। জুটলে খাই, না জুটলে খাই না। চুল লম্বা হয়, হাত-পায়ের নখ বাড়ে। শরীরে ময়লার পুরু পলেস্তারা। জামাকাপড় ফুটিফাটা। এসব বাহ্যিক বিষয়কে তুচ্ছজ্ঞানে অবহেলা করি। আমার লক্ষ্য পাখির চোখ। উদভ্রান্তের মতো বউয়ের পছন্দ অনুযায়ী ডাক্তার খুঁজে বেড়াই।
এভাবে খুঁজতে খুঁজতে একদিন এক ডাক্তারের দেখা পেলাম। ভদ্রলোক প্লাটফর্মে মাইক ফুঁকে ওষুধ বিক্রি করছিল। তাকে আড়ালে ডেকে আমার সমস্যার কথা জানালাম। ভদ্রলোক বউয়ের পছন্দ অনুযায়ী ওষুধ দিতে রাজি হলেন।
আমি আনন্দে নাচতে নাচতে ওষুধের ঠোঙাটা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বউকে বললাম, এই দেখ, পেয়েছি। তোমার পছন্দ মতো ওষুধ। যা খেলে মাথা ব্যথাও কমবে আবার জীবনে উন্নতি করা যাবে। মানে আগে লাল…
বউ আমাকে থামিয়ে দিল। বলল, চলবে না। সময় পেরিয়ে গেছে। টাইম ইজ ওভার।
-মানে! আমি অবাক হলাম।
বউ বলল, আগে সবুজ খেতে হবে।

আমি আবার ডাক্তার খুঁজতে বেরিয়েছি।
আরও পড়ুন: রবিবারের ছোটগল্প অবসাদের দাওয়াই লিখেছেন শর্মিষ্ঠা দত্ত

Check Also

গল্প

রবিবারের ছোটগল্প চাঁদ ছোঁয়ার গল্প লিখেছেন সাগরিকা রায়

ছোটগল্প Illustration: Preety Deb কচু গাছের আড়ালে দাঁড়ালেও চান্দু নিজেকে বেশ লুকোতে পারে।গজু বলে, ভাই …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *