ছোটগল্প
শূন্য থেকে শুরু
অমিতাভ দাস
Illustration: Preety Deb
একটা লোক সেই থেকে চিৎকার করেই চলেছে। চলছে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল। দুপুরের প্রবল রোদ্দুর মাথায় নিয়ে ওরা যখন ট্রেনে উঠেছিল বেলা দেড়টা। আরো এক ঘন্টা পর ছাড়বে রামপুরহাট প্যাসেঞ্জার । আগে এসেছে বলে সবাই বেশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে। সুবিমল জানালার কাছে একটা ভালো সিট পেলেও রোদ্দুর আসছে। বোলপুর এলে পরে সে উঠে দেবশংকরের পাশে এসে বসল।
কোথা থেকে লোকটা চিৎকার করছে বুঝতে না পারলেও, ফোনে ফোনে কথা চলছে। কথা বলতে ঝগড়া। আর সেটা যে বৌ-এর সঙ্গে তাতে সন্দেহ নেই সুবিমলের।
তারাপীঠ থেকে সে ফিরছে বন্ধুদের সঙ্গে। ট্রেনের লোকজন মূলত টুরিস্ট। কেউ কেউ স্থানীয়। অনেকেই মুখ টিপে হাসছে। বেশ মজা পাচ্ছে কেউ কেউ। সুবিমল মন দিয়ে শোনার এবং বোঝার চেষ্টা করছে ঘটনাটা ঠিক কী! লোকটা বলে চলেছে, কেন এখন ফোন করেছিস কেন? তোর নাগর বুঝি কাছে নেই? না না না, আমি বাড়ি ফিরব না… তোর মতো মাগীর মুখ দেখা পাপ…
ফোন কেটে গেল। বুঝলাম লোকটার কথায়, বালের নেট- কথা শোনা যায় না। কেটে গেল। হ্যালো হ্যালো…
ফোন আবার বেজে উঠল। আবার ফোন করেছিস কেন? আমি তো সব দিয়েই এসেছি। আমি ফিরব না। তোর নাগর এখন কোথায়? ওপরে না নীচে…? দেখলাম, আমার উল্টোদিকের এক বিবাহিতা মুচকি হাসছে। কেউ কেউ একটু উঁচু হয়ে দেখলে। একজন বললে, মাল খেয়ে বকছে। অন্য একজন বললে, আধ পাগলা…
লোকটি বলতে থাকে, ও কি এখন ওপর তলায় আমাদের ঘরে শোয়, নাকি এখনো তুই যাস নীচে… একদম কথা বলবি না খানকি… তোর মুখ দেখা পাপ… আমি ফিরে কী করব… তোদের কেচ্ছা দেখব… সেদিন যেমন দেখালি!
এবার তো উঠতেই হচ্ছে, বলে সুবিমল উঠে দাঁড়াল। লোকটির ফোন আবার কেটে গেছে বোধহয়। আবার সব চুপ। ট্রেন চলছে। মাঠ-নদী-ক্ষেত পেরিয়ে ট্রেন চলছে। দেবশংকর বললে, কোথায় চললে
গল্প খুঁজতে? বললে সুবিমলকে।
পেলে জানিও, বলে ফেসবুকে মন দিল দেবশংকর।
দরজার কাছে এগিয়ে গেল সুবিমল। সে যেন গল্পের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। যে লোকটির কথা এতক্ষণ সে শুনছিল, তার মুখোমুখি দাঁড়াল। লোকটিকে দেখে খুব চমকে গেল সে! কারণ লোকটিকে সে সকালবেলা তারাপীঠ শ্মশানে দেখেছে। মুখটা মনে আছে এই জন্য যে লোকটি অন্য সাধুসন্তের মতো নয়। ভেক হতে পারে! সুবিমল জানে না। আবার লোকটাকে সুবিমল দেখেছিল কাল সন্ধ্যায় মন্দির লাগোয়া একটা লজ থেকে বেরুতে। গলায় রুদ্রাক্ষ মালা। পরনে লাল বস্ত্র। কপালে বড় একটা গোল সিঁদুর। একটা লাল পুঁটুলি মাথার নীচে রেখে সে শুয়ে আছে ট্রেনের দরজার কাছে। আর অশ্রাব্য ভাষায় গাল দিচ্ছে ফোনে কাউকে। বয়স ষাটের ওপর। মাঝারি গড়ন। সাদা-কালো চুল। ডান হাতে একটা স্টিলের বালা।
লোকটার পাশে ট্রেনের দু-চারজন আছে। একজন হকারের থেকে একটা বিড়ি চেয়ে নিল লোকটা। কানের কাছে বিড়িটা একটু আঙুল দিয়ে ঘষে নিয়ে দেশলাই ঠুকে জ্বালিয়ে মুখে দিল। লম্বা লম্বা দুটো টান দিয়ে সুবিমলের দিকে তাকিয়ে বললে, ওই একটা জাত যাকে বিশ্বাস করা যায় না। সুবিমল চুপ করে শুনছিল। অন্য এক অল্পবয়সি যাত্রী বললে, কোন জাত বাবা।
-যারা ঠকায়। চিট করে। কিছু নেই কিছু নেই। সব শূন্য। ফাঁকা রে, সব ফাঁকা। শূন্য থেকে শুরু। শূন্য, আবার শেষেও শূন্য। দশেও শূন্য আবার একশোতেও শূন্য। ওদের কাছে মন পাবি না।
সুবিমল কথা বলছে না। মন দিয়ে শুনছে। ওর নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। সে দরজা কাছে দাঁড়িয়ে। রুচিরার কথা এতকাল পর ভেসে উঠল চোখের সামনে। রুচিরার বিয়ে হয়ে গেল, তাও কত কাল হল। শুনেছে এখন প্রবাসী। বর নেভিতে চাকরি করে, বড় অফিসার।
আবার লোকটার ফোন বেজে উঠল, সে বলতে লাগল, এবার কিন্তু ফোনটা ছুড়ে ফেলে দেব। আবার ফোন করছিস আমায়। নিজে তো ফূর্তি মারছিস। আমায় কেন ফোন? তোর কয়টা লাগে?
উত্তেজিত লোকটি তারপর নিজেই ফোন রেখে দিল। একজন যাত্রী বললে, কে বাবা? কাকে গাল দিচ্ছ?
-শালা, এখনো বুঝিসনি! আমার বউ। বাড়িতে একটা ভাড়া দিয়েছিলাম। একটা ছেলে থাকত। কাকু কাকু করত। তারপর একদিন দেখলাম… সব ছেড়ে দিলাম। বাড়িটা ওর নামে। থাক। যা ইচ্ছা করে করুক। ঘেন্না করে এখন আমার। খুব ঘেন্না করে। দু-বছর ধরে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সংসারে আর ফিরব না। মাগী রোজ ফোন করে আর আমার ভিতরটা জ্বলে- পুড়ে যায়।
-কোথায় তোমার বাড়ি বাবা?
-সন্ন্যাসীর আবার বাড়ি! আমার কোনো বাড়ি নেই। আগে একটা বিরাট বাড়ি, গাড়ি, চাকরি ছিল বটে। যাবো এখন বেহালায়। মায়ের কাছে। তিনি যদ্দিন আছেন তাঁর কাছে যেতে হবে। বলে ফোনটার সুইচ অফ করে দিল।
আরও পড়ুন: রবিবারের ছোটগল্প রামদুলালের ঢোল লিখেছেন মিলন বনিক