ছোটগল্প
Illustration: Preety Deb
“এই ছেলে কি করছ, এদিকে এসো !”
অনেকটা আদেশের সুর। মনে করলাম ম্যাডাম হবেন হয়তো, আমি নতুন ভর্তি হয়েছি, এখনও তেমন কারও সাথে পরিচয় হয়নি। কাছে গেলাম। মেয়েটি বেশ কালো, তবে তার চোখ-জোড়াতে কি যেন আছে, তখন ঠিক ঠাহর করতেই পারলাম না।
এই ছেলে, তোমার কোন ইভেন্ট?
আবৃত্তি
কি আবৃত্তি করবে?
“বোধ”
এত শক্ত কবিতা তুমি আবৃত্তি করতে পারবে?
জ্বী, আপু (ততক্ষণে বুঝে গেছি তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের বড় আপু)।
তুমি জীবনানন্দ বুঝ?
মনে মনে একটু বিরক্ত হলাম, তবু তার ছিটেফোঁটাও প্রকাশ করা গেল না। আসলে অমন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে তেমন কিছুই বলা যায় না। বললাম, জ্বী আপু, বুঝি। বরং বেশিই বুঝি, জীবনানন্দতো আমায় কবিতা লিখতে শিখিয়েছেন!!
এই কথায় আপুর চোখটি বেশ চঞ্চল হয়ে উঠলো। তার মানে তুমি কবিতাও লেখ?
জ্বী…
আমায় দেখাতে পারো? যেটি তোমার খুব প্রিয় এবং যেটির বোধ তুমি চোখ বন্ধ করলেই সম্পুর্ণ দেখতে পাও!
তেমন কবিতা আছে নাকি তোমার?
জ্বী, আছে!
ওকে। তুমি বের করো, আমি অন্যজনদের নামগুলি নিয়ে নিই। এই বলে তিনি আমার অন্য ক্লাসমেটদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। আগামী কালকের অনুষ্ঠানে কে কি করবে তার লিস্ট করে নিচ্ছেন। সেই সঙ্গে সবাইকে প্রস্তুত হতে বলছেন, তার সামনে একবার করে তারা যেন পারফর্ম করে দেখায়…
আমার দিকে তাকি আবারও বললেন, “এই ছেলে এদিকে এসো।” সেই একই আদেশের সুর! আমি গেলাম, বাকিরা যে যার জায়গায় বসে রিহার্সাল করতে লাগলো।
দেখি তোমার কবিতা?
এখানে বলে রাখা ভালো আমার কাছে সবসময় আমার ডায়েরিটি থাকে। ডায়েরিতে আমি হাইস্কুল থেকেই কবিতা লিখি, যদিও সেগুলো ঠিক কবিতা কিনা সেটা অন্যের মুখ থেকে কখনও শোনা হয়নি। যা হোক আমার খুব প্রিয় একটা কবিতা “অস্পর্শের পর্শে” তাকে দেখালাম। তিনি বললেন আগে আমাকে পড়তে দাও, তারপর তোমার আবৃত্তি শুনবো। তিনি পড়লেন। বললেন, এবার আবৃত্তি করো।
আবৃত্তি করলাম, তখন হঠাৎ করেই তিনি বললেন, তুমি একটু ব’সো আমি আসছি। কিন্তু আমিও লক্ষ করলাম তার অসামান্য চোখ দু-টিতে কি যেন ছলকে উঠলো।
কিছুক্ষণ পরে তিনি এলেন। অনেকটা ফ্রেশ লাগছে তাঁকে। বোঝা-ই যাচ্ছে, মুখ ধুয়ে এসেছেন। এসেই তিনি আমাকে আবৃত্তির কিছু টিপস দিলেন এবং বললেন, তোমার আবৃত্তিটা আর সবার সামনে এখন শুনবো না। তুমি বাসায় গিয়ে কয়েক বার প্র্যাকটিস করবে, আমি যেভাবে বলে দিলাম। কালকে অনুষ্ঠানেই তোমার আবৃত্তি আমরা সবাই শুনবো। তোমার প্রতি বিশ্বাস রাখলাম।
আমি মেসে এলাম। তখনও হলে সিট পাইনি। কয়েকবার রিহার্সল করলাম। কেন জানি অন্তর থেকে আপুটির বিশ্বাসের ওপর ভিশনই মায়া হচ্ছে, সেই সঙ্গে ওই চোখ!! কি-যে আছে তখন পর্যন্ত ঠাহর করতে পারিনি।
পরদিন যথাযথভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠান হল। পুরো অনুষ্ঠানটি সেই আপু ও এক বড় ভাই উপস্থাপন করলেন। আপুটি একটি গানও গাইলেন এক-অসাধারণ গলায়। আর আমিও আবৃত্তি করলাম। আবৃত্তিটি একদম অন্তর থেকে হল। যেন কবিতাটির পুরো বোধ আমার চোখের সামনে ভাসছিল।
সবাই আমার কবিতার অনেক প্রশংসা করেছিল। একটি অন্যরকম সুখ, অন্যরকম ভালোলাগায় সেদিন হৃদয়টা সত্যই আচ্ছন্ন হয়েছিল। মনে মনে সেই আপুকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। জানি, তিনিই এটি করিয়েছেন আমাকে দিয়ে।
আপুটির নাম লোপা। তিনি থার্ড ইয়ারে পড়তেন।
এভাবেই ক্রমশ আমরা জড়িয়ে পড়লাম এমন একটা সম্পর্কে যা পুরো ক্যাম্পাস মনে রেখেছিল বহু বছর! আর আমি মনে রাখছি সারা জীবন।
তিনি আমায় পূর্ণ করে দিয়েছিলেন, যার শুরুটা ছিল সেই আবৃত্তি দিয়ে।
আমাদের প্রতিদিনই কথা হতে থাকলো অনেক সময় ধরে। তবে তিনি কখনো ক্লাস ফাঁকি দিতেন না এবং আমাকেও দিতে দিতেন না।
আমরা একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিলাম। হাস্যকর একটা প্রজেক্ট। আমাদের চার পাশে কারা কারা বসতো তার হিসাব রাখতাম। বিশেষ করে ছেলে আর মেয়েদের যুগল রূপের। এভাবে এক বছরে একটা ছেলের বা মেয়ের কয়টা সঙ্গী বদল হত তার হিসাব আমাদের কাছে থাকতো। কখনও কখনও সঙ্গী বদলের সংখ্যা পাঁচ/ছয়বার পর্যন্ত হয়ে যেত।অবশ্য গুটি কয়েকের যে সঙ্গী বদল হত না এটাও ঠিক। এভাবে কেমন করে যেন অন্তর-ভালো মানুষগুলিকে চিনতে শিখলাম।
ক্রমে আমাদের মেলামেশা অনেক বেড়ে গেল। তিনি সত্যই খুব সুন্দর গান গাইতেন। আমরা গল্প করতাম জগতের সব বিষয়ে। তিনি আমার কবিতাগুলোকে আরো গভীর করাতে সাহায্য করতেন।ক্যাম্পাসে আমার কবিতার চর্চা ভালোই হত। শুধু তা-ই নয়, তিনি আমায় খুব উৎকৃষ্ট মানের উপস্থাপক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন। শুধু আমাদের বিভাগেই নয়, ক্যাম্পাসের সকল অনুষ্ঠানেই আমরা যুগলে উপস্থাপন করতে লাগলাম। এভাবেই আমি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের বিভাগ সহ ক্যাম্পাসের অনেক মেয়েই আমাকে পেতে চেয়েছিল, অথচ খুব যত্নের সঙ্গেই তিনি আমায় আগলে রেখেছেন সব রকম ঝুঁকি থেকে।
তার সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক কি তা জগতের পরিচিত কোনো সম্মন্ধ দিয়েই পরিচিত করানো যাবে না। মোট কথা জগতের সকল আত্মীক সম্পর্ক দিয়েই তিনি আমায় ধারণ করেছিলেন। এদিকে পুরো ক্যাম্পাস আমাদের নিয়ে নানান কথা বলতো, বিশেষ করে আমাকে যারা পেতে চেয়েছিল তারা ওঁর নামে কুৎসা রটাতে সদা ব্যস্ত থাকতো। স্বাভাবিক ভাবেই ওঁকে-ই সবাই দোষ দিত। এমন কথাও শুনেছি তিনি নাকি আমায় তার শরীর দিয়ে নিজের করে রেখেছেন। আর সবাই আমার প্রতি মায়া দেখাতো, ঠিক মায়া না বলে করুণাই বলা-ই ভালো। অথচ আমি তো জানি, তিনি আমায় কারো হতে দেননি। তিনি আমায় তার নিজেরও করে নেননি, অথচ আমায় শুধু আমার করে দিয়েছিলেন।
তার সম্মন্ধে এসব বাজে কথা আমায় খুব কষ্ট দিত।
কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় এসবে তাকে কখনো বিচলিত হতে দেখিনি। আমার খারাপ লাগতো, তিনি আমাকে বুঝাতেন। বলতেন, ওরা অহৃদ ওরা কি বুঝবে সুহৃদের মর্যাদা। কেন আমরা এমন কারো কথায় মন খারাপ করবো। যাদের প্রতি আমাদের কোনো অধিকার নেই। কোনো দায় নেই। কেন তাদের কথায় আমরা আমাদের মনের প্রশান্তি হারাবো। এসব কথা আমি প্রথম প্রথম একদম বুঝিনি। কিন্তু ক্রমে এমন সুন্দর একটা গুন আমি আত্মস্থ করে নিলাম। যা আমাকে বিনয়ী করলো, আমাকে মানসিক ভাবে প্রচন্ড স্থির করলো। আমাকে ভালোবাসতে শেখালো।
৩.
এমন চোখ আর কখনো দেখিনি। এমন ব্যক্তিত্ব আর একটাও মেলেনি। আমাদের মাঝে নিজেদের একান্ত বলে কিছু ছিল না। আমরা একে অপরের হৃদয় দেখতে পেতাম। যেন পরস্পরের আয়না। আজ বুঝি তিনি তার সবটুকু দিয়ে আমায় তৈরি করেছিলেন। সেখানে স্নেহ ছিল, মমতা ছিল, প্রেম ছিল, শাসন ছিল। তিনি তিন বছরে আমাকে সম্পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। অথচ কোনো ঋণ কিন্তু মনে হয়নি। মনে হয়েছে, সেটা আমারই প্রাপ্য। আসলে পরে বুঝেছি অমন বোধ উনিই তৈরি করে দিয়েছিলেন।
লোপা আপু বাড়িতে ভিশন মানসিক কষ্টে থাকতেন। তারা মোট ছয় ভাই বোন। তিনি সবার বড়, বাকি পাঁচ জন অন্য মায়ের। মা তার পাঁচ বছর বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। তিনি সবাইকেই আপন করেছিলেন কিন্তু কারোরই কাছে নিজে আপন হতে পারেননি। বাদ-বাকি পরিবেশ পাঠক নিশ্চয় বুঝে নেবেন। এমন পরিবেশ তো খুব একটা অপরিচিত নয়? তাই ও-বিষয়ে আর কথা বাড়ালাম না।
একদিন আমরা চরে হাঁটছিলাম। খুব রোদ, এমন সময় তিনি স্যান্ডেল খুলে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি একটু আশ্চার্য হলাম। বললাম, কি করছেন ! পা তো পুড়ে যাবে ! উনি বললেন চিন্তা করিস না। কষ্ট সহ্য করার প্র্যাকটিস করছি। আমিও খুলে ফেললাম। বালু সত্যই খুব গরম ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। অথচ তিনি নিজে ছিলেন নির্বিকার। সত্যিই তার মানসিক শক্তি অনেক। পরে মনে হল, আমার উপর মায়া করেই তিনি স্যান্ডেল পরে নিলেন। আমিও বাঁচলাম।
আমি জানি আমাকে তিনি কষ্ট পেতে শিখিয়েছিলেন। কিভাবে অন্যের জন্য কষ্ট পেতে হয়, অন্যের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করতে হয় এবং কিভাবে তাতে নিজের মধ্যে সুখ সঞ্চার করতে হয়। তিনিই শিখিয়ে ছিলেন। তবে কিভাবে তা জানি না। তিনি চলতে চলতেই আমায় সবটুকু দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কখনও মনে হয়নি শিখছি। পরে অনেক পরে সব বুঝেছি। এবং অনেক পরে চিনেছি তাকেও। সত্যই অনন্য তিনি। আমি আর দেখিনি। হয়তো আর নেইও।
এভাবেই তিনটি বছর শেষ হয়ে গেল চোখের নিমিষেই। তার মাস্টার্স পরীক্ষা হল আর আমি থার্ড ইয়ারে উঠলাম। এই সময়গুলিতে তার চঞ্চলতা ক্রমশ কমে যেতে থাকলো। তিনি সবসময় দু-হাত পেছনে ঠেস দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে কথা বলতেন, নয়তো একদম চোখের দিকে তাকিয়ে। এতটা গভীর চোখে এতটা স্পস্টভাবে আর এতটা জল আমি আর কখনও-ই দেখিনি। তিনি বলছেন আকাশের দিকে চেয়ে, “জানিস বাবু, তোর বউ তোকে খুব ভালোবাসবে। কেন জানিস? আমি ছিলাম বলে।” কথাটি তখন ঠিক বুঝিনি কিন্তু জিজ্ঞেসও করিনি, কারণ যে ভাষায় ও যতটা স্থিরভাবে তিনি বললেন, সেখানে কোনো প্রশ্নই চলে না।
তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস?
কেন?
না, এই তিন বছরে কত কত সুন্দর মেয়েরা তোকে প্রপোজ করলো অথচ তোকে তাদের হাতে ছেড়ে দেইনি।
রাগ করবো কেন! আমার তো ওরকম মনেই হয়নি।
হুম।
তুই কতটা সুন্দর, জানিস?
জানি তো !
ভুল ! রূপের সৌন্দর্যে অসচেতন আর মনের সৌন্দর্যে সর্বদা সচেতন থাকবি। জানি তুই পারবি।
আচ্ছা আপু, তুমি আজকাল অনেকটা গম্ভীর থাকো, আর আমার চোখের দিকে একদম তাকাও না। জানোই তো তোমার চোখের দিকে না তাকালে আমার কথাই বের হয় না।
এই শোন? আমার খুব ইচ্ছা তোর বউকে আমি পছন্দ করে দেবো। কিন্তু তা কি সম্ভব হবে রে ! তোর পড়া শেষ হতে আরো অনেক দেরি। তারপর চাকরি… অনেক সময়! তবু একটা কথা মনে রাখবি, জগতে কেউ-ই কারোর মতো নয়। মেলাতে যাবি না। তোর ঘরে যেই-ই , যেমন-ই আসুক, ভালোবাসবি। তৈরি করেই ভালোবাসবি।
আচ্ছা কদিন ধরে খুব গম্ভীর গম্ভীর কথা বলছ কেন?
এই বোকা, আমি কি তোর বউ হব নাকি রে, যে চিরদিন তোকে মানুষ করবো। আমাকে তো যেতে হবেই।
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে কথাটি বললেন। আমার চোখে পানি চলে এলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, কেন? বউ না করে কি কাছে রাখা যায় না? তোমায় সারাটি জীবন কাছে রাখবো ! যদি দরকার হয় বউ করেই রাখবো !
এই চুপ ! দেবো একটা কানের নিচে। আমায় বউ করবে, সাহস কত বড় পিচ্চির। এই শোন, পরীক্ষা শেষ হল তো। ক’দিন দেখা হবে না কে জানে। তুই নিজের খেয়াল রাখিস। আমায় একটা রিকশা ডেকে দে, ভাড়াটাও দিয়ে দিস।আমার কাছে টাকা নেই।
আর একটা কথা শোন
আমরা পারিপার্শ্বিকতাকে অতিক্রম করেছি পরিস্থিতি ছিল বলেই। সবসময় কিন্তু এমন হয় না। জীবন পারিপার্শ্বিকতাকে অতিক্রম করতে পারে না। জীবন জীবনকেও অতিক্রম করতে পারে না। জানি তুই হয়তো পারবি, আমি কিন্তু পারি না। যা এবার রিকশা ডেকে দে…
তিনি চলে গেলেন, চলেই গেলেন। আমার কান্না আসছিল। দ্রুত রুমে চলে গেলাম। আমাদের দেখা হয়নি দেড়মাস। এর আগে কখনও-ই এতদিন আপুকে না দেখে থাকিনি। মনে হচ্ছে বহু বছর দেখিনি। সবসময় বিমর্ষ থাকি। অথচ আশ্চার্য ভাবে মনে হয়, সবসসয় সেই চোখ, সেই দুটি চোখ আমাকে দেখছে। স্পষ্টই দেখতে পেতাম। কখনও-ই কল্পনা মনে হয় নি।
হঠাৎ ঠিক একমাস বিশ দিনের মাথায় আপু রিং দিলো। নাম্বারটা এতদিন বন্ধ ছিল। আমি বোধহয় ক’য়েক লাখবার রিং দিয়েছি।
হ্যালো ! বাবু ! ঢাকা বাস স্ট্যান্ডে একটু আই তো !
জ্বী আপু, আসছি !
এত দেরী করলি কেন?
রিকশা পাচ্ছিলাম না। যদিও খুব বেশি হলে বিশ মিনিট সময় লেগেছে তবুও কিছু বলতে নেই, ওকে কিছু বলা যায় না।
ঢাকায় যেতে হবে ! পারবি যেতে?
জ্বী আপু !
চল, বাস এক্ষুনি ছাড়বে।
টিকিট কেটে আনি?
না, আমি কেটে রেখেছি। চল এবার। ব্যাগটা নে। বাসে সব বলবো।
বাসে উঠলাম। উনি জানেন আমি জানালা ধার ছাড়া বসতে পারি না। আমি বসলাম। তিনি এক প্যাকেট তেতুলের আচার বের করে দিলেন। তিনি এটাও জানেন আমি বাসে চড়লেই বমি করি। তাই তিনি সব রেডি করেই রেখেছেন। বাস ছাড়লো।
তুই তো জানিস আমার বাড়ির পরিবেশ। ওখানে আর থাকা যাচ্ছে না রে ! একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি। আমি কখনও ঢাকা যাইনি। তাই তোর সঙ্গে যাচ্ছি।
কিসের চাকরি?
চল তো আগে। দেখবি বলেই তো তোকে নিয়েছি। ওখানের পরিবেশ দেখবি। মানুষ গুলোও দেখিস। ঠিক জানিনারে। টেনসান হচ্ছে।
আচ্ছা আমার কাছে থেকে যাও না? চিরদিন তোমায় আগলে রাখবো !
আমি জানি তুই তা পারিস। কিন্তু কিভাবে যাবো বল। সমাজ চিরটাকাল আমায় গালি দেবে আর তোকে করুণা করবে। আমি কি পারি এমন পরিবেশ তোকে দিতে?
জ্বী, আপু।
বাবু, একটা কথা শুনবি?
হুম।
আমার যখন অনেক বয়স হবে তখন খুঁজে খুঁজে আমায় বের করবি? তখন কেউ যদি আমার না থাকে, আমায় নিয়ে আসবি? কি আনবি তো?
এবার আমি কেঁদেই ফেললাম।
বাবু আমার কাঁদেনা। আমি জানি তুই ঠিকই আমায় খুঁজে বের করবি। আমায় আনবি। তখন সমাজ কিন্তু আর কিছু বলবে না। জানিসই তো মানুষ শুধু একটা জিনিসই বুঝে। আর তারা মনে করে ওই একটা জিনিসের কারণেই একটা ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক হয়।
বাসে আমি দু-প্যাকেট আচার খেয়েছি, অনেকটা পথ ঘুমিয়েছি আপুর ঘাড়ে মাথা রেখে। তবুও শেষ মুহুর্তে বেশ কবার বমি হল। বমি করাটা সত্যই খুব কষ্টের। গাড়ি থেকে নামলাম। নেমে আরেক দফা। শরীরে আর কোনো শক্তি পাচ্ছি না। আপুই ব্যাগ নিল এবং আমাকেও। আমরা সিএনজিতে উঠলাম, আবারও ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমের চেষ্টা করলাম। গাড়ি থেকে নামলাম, মানে আপুই নামালো। বলল, এই বাবু তুই আমাকে নিয়ে এসেছিস না আমি তোকে? কথাটা শুনে একটু লজ্জাই লাগলো। যা হোক আমি তিনদিন ছিলাম ওখানে, আপুর সাথে।তার অফিস দেখলাম, মানুষগুলোও দেখলাম। খুব খারাপ না লাগলেও মন কেন যেন খুঁত খুঁত করছিল। তিনি একটা মহিলা মেসে রুমও নিলেন। বললেন, এবার তোকে যেতে হবে বাবু। বললাম, রাখা যায় না আমাকে? তিনি বললেন নারে। তোকে অনেক বড় হতে হবে। এত বড় যেন সব পরিস্থিতি সব পরিপ্রেক্ষিত তোর অধীনে থাকে। তবেই না শেষ বয়সে আমায় রাখতে পারবি।
আমি চলে এলাম। তিনি বললেন, টিকিটের টাকা আছে তোর কাছে? যা তাহলে। আমার কাছে টাকা আছে তবে তোকে দিতে পারছি না। একটা মাস চলতে হবে।
আমার কাছে বেশ কিছু টাকা আছে, তুমি কিছু নাও!
তুই পুরো মাস চলবি কি করে?
আমি ম্যানেজ করে নেবো। কিন্তু এখানে তুমি তা পারবে না। ভাড়ার জন্য রেখে বাকিটা সবই দিলাম।
এই শোন, আমার সিমটা নে। এটা তোর কাছে রাখিস। আমি নতুন সিম নিয়েছি, তোকে নাম্বার পাঠিয়ে দেবো। তুই যা এবার।
চলে এলাম, পেছনে অনুভব করলাম জগতের সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্রের বাঁধ ভেঙেছে।
পিছনে তাকাইনি, সাহসই পাইনি।
ঢাকা থেকে এসে আমার পরিস্থিতি আমাকে ও তারটা তাকে আচ্ছন্ন করে নিলো ক্রমশ। কথা যে হত না তা নয়। প্রথম প্রথম প্রতিদিনই বেশ কবার কথা হত ফোনে। আস্তে আস্তে কমে গেল একদম। তিনি অফিসে খুব উন্নতি করলেন। আমি আমার কবিতা ও পড়ায়।
হাঠাৎ একদিন ফোনে আপু বলল, বাবু, তোর সাথে আর কথা হবে নারে। ফোনটা আজ থেকে বন্ধ করে দিলাম। তুই ভালো থাকিস। আর আমাকে আলাদা ভাবে মনে করার দরকার নেই। তুই তোর মনের সুন্দর দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করবি আর সেগুলির যত্ন নিবি তাহলেই হবে। তুই ভালো থাকিস।
আমি কোনো কথা বলতে পারিনি।
তারপর অনেক স্রোত বয়ে গেছে পদ্মায়, নতুন নতুন চরও জেগেছে অনেক। আমার ভেতরেও তেমন। সময় অনেকটা ব্যস্ত করে দিয়েছে। আলাদা ভাবে তাকে মনে করতে বসি না। কিন্তু হৃদয়ের সুন্দর দিকগুলা যখন চলে আসে তখন মনের অজান্তেই সেই চোখ দু’টি মনের মাঝে পলক ফেলে। অসাধারণ অনন্যা যিনি আমাকে অনন্য করেছেন, যিনি আমাকে আমার করে দিয়েছেন। ভালো থাকতে শিখিয়েছেন ও ভালোবাসতে। সেই চোখ দু’টির মতো একটা অনুভবও এই হৃদয়ে স্থির হয়েছে, যার কারণে আমি বলতে শিখেছি ভালোবাসার বিপরীত শব্দ ঘৃণা নয়। আজ যখন ক্লাশে লেকচার দেই, আমাকে শেখানো অনেক কথাই আমি ছাত্রদের শেখাই। কিভাবে হৃদয় গড়তে হয়, কিভাবে ভালোবাসাকে অসীম করতে হয়।
যাই হোক অনেক সংক্ষেপে, ঘটনা কেটে কেটে গল্পটা বলার চেষ্টা করেছি। তবুও অনেকটা বড় হয়ে গেল। তবু শেষ বলতে কিছু একটা থেকে গেছে।
ঢাকা নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা আমায় ফুল দিয়ে বরণ করে নিলো। অদ্ভুত সুন্দর চিরচেনা দু’টি চোখ। বাচ্চাটি ভিড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল। আমি একটুও স্থির থাকতে পারছিলাম না। কোনো রকমে অনুষ্ঠানের সময়টা পার করলাম। ভিসি মহোদয়কে বাচ্চাটির কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ও-আমাদের এক অধ্যাপকের ছেলে, এবং সে তার বাবার সাথে কোনো কারণে বাসায় চলে গেছে। খুব নিরাশ হলাম। একটুও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। মনে মনে একটা বুদ্ধি আঁটলাম। ভিসি মহোদয়কে বললাম আমি বাচ্চাটিকে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই। উনি বললেন, বেশ তো। ওর বাবার ফোনে রিং দেই। উনি কল দিলেন কিছু কথা বলে ফোনটা আমায় দিলেন,
হ্যালো…বাবু তোমার নাম কি?
আমার নাম তো বাবু!!
ওহ্, বাবা খুব সুন্দর নাম। তুমি কি জানো বাবা, আমার নাম?
না তো!
আমি বললাম, আমার নামও বাবু। তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে ফোন করেছি। ফুল দিয়ে আমায় বরণ করার জন্য, তোমায় অনেক ভালোবাসা বাবু।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। মনে হল, পাশ থেকে কেউ শিখিয়ে দিচ্ছে।
আচ্ছা বাবু, তোমার আব্বুর নাম কি বল তো?
আবু হায়দার চৌধুরী
তোমার আম্মুর নাম?
সাদিয়া জামান লোপা।
আমি চিনলাম, আমি জানলাম, সেই চিরচেনা চোখের মায়ায় অনুরূপ আরেক জোড়া সৃষ্টি হয়েছে এই পৃথিবীতে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম বাবু তোমায় কিছু উপহার পাঠাতে পারি? কিছুক্ষণ দেরিতে উত্তর পেলাম,
জ্বী আংকেল।
তোমার কি পছন্দ বাবা?
ক্নক ওয়েফার।
ঠিক আছে বাবা, আমি পাঠিয়ে দেবো। তোমার জন্য দোয়া রইলো।
আমি বাইরে এসে চকলেটটি নিলাম। আর একটা চিরকুটে লিখলাম…
বাবু,
তুমি অনেক বড় হও। এত বড় যেন সব পরিস্থিতি সব পারিপার্শিকতা তোমার অধীন হয়ে যায়।
ইতি-
তোমার আংকেল।
আমার ফোন নাম্বারটা দিয়েছিলাম…
আরও পড়ুন: রবিবারের ছোটগল্প দৃষ্টি লিখেছেন নীপবীথি ভৌমিক