Home / রবিবারের আড্ডা / রবিবারের ছোটগল্প সেদিনও আকাশে তারা ছিল লিখেছেন রুনা তাসমিনা

রবিবারের ছোটগল্প সেদিনও আকাশে তারা ছিল লিখেছেন রুনা তাসমিনা

ছোটগল্প

সেদিনও আকাশে তারা ছিল

রুনা তাসমিনা

গল্প

Illustration: Preety Deb

যেন আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। অঝোর ধারায় সেই গতরাত থেকেই ঝরছে বৃষ্টি। এ রকম বৃষ্টিতে কাঁথা থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না। তবুও উঠতে হবে। কাজে না গেলে মালিক যে খিস্তি খেউড় শোনাবে তা শুনতে মোটেও রাজি নয় রাসেলা। আড়মোড়া ভেঙে নেমে আসে প্রায় ভেঙে যাওয়া বিছানা থেকে। বাইরের অবস্থা দেখার জন্য দরজা খুলে। রাস্তা তলিয়ে গেছে পানির নীচে। ঘন্টা খানেক এভাবে বৃষ্টি পড়তে থাকলে পানিতে ডুবে যাবে তার ছোট্ট কুঁড়ে ঘরটিও। তবুও রক্ষা নেই। গরীবের এসব দুর্দশার কথা, উপর তলায় বাস করা মালিক শুনবে কেন? তাদের দরকার কাজ আর কাজ। চাই কাড়ি কাড়ি টাকা! উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলো থেকে ঠিকই দেখা যায় পানিতে তলিয়ে যাওয়া রাস্তা, বস্তিগুলো। ওরা দেখে না, চোখ বন্ধ করে চুমুক দেয় চায়ের পেয়ালায়। ফ্যাক্টরিতে কাজ করা কেউ যদি তাদের দেরি বা কাজে না আসার জন্য এই অসুবিধার কথা বলে, তারা এমন ভাব দেখায় যেন কখনো শুনেইনি পানিতে শহরের রাস্তা ডুবতে পারে।
“দুর! ওই সব বড় মাইনষের কথা ভাইবা আমার আরো দেরি অইব।”
মনে মনে ওদের উদ্দেশ্যে একশো গাল পেড়ে রান্নাঘরে এসে চুলায় ভাত বসায়। ভাই বোন দুটি একা থাকবে ঘরে। টুনির বয়স বার, রাজুর দশ। তাদের আজ আর স্কুলে পাঠাবে না। সে নিজে তৈরি হতে থাকে কাজে যাওয়ার জন্য।
মা মারা যাওয়ার পর বাবা যখন আরেক বিয়ে করে ওদের ছেড়ে চলে গেলো, খবর শুনে তিন ভাইবোনের কান্না দেখতে বস্তির অনেকেই এসেছিল। কিন্তু কাছে ডেকে নেয়নি কেউ। পাশেও থাকেনি। তিনজনের বোঝা খুব ভারি মনে হয়েছিল আত্মীয় নামের স্বজনদের কাছে। শেষে চোখ মুছে রাসেলা ছোট দুটি ভাইবোনকে বুকে টেনে নিজের সাথে শপথ এখন থেকে এদের বাবা-মা দুজন হয়েই সে থাকবে। চলে যাচ্ছে তো দিন। দেখতে দেখতে মাঝখানে চলে গেল চারটি বছর। মায়ের সহযোগিতায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছিল। বাবার সাথে মার অনেক ঝগড়া হতো তার স্কুলে যাওয়া নিয়ে। অনেকবার মারও খেতে হয়েছে। তবুও দমে যায়নি মা। বাসায় ঝি গিরি করে যা পেতো তা দিয়ে চলত সংসারের খরচ। বাপ রিক্সা চালিয়ে যা পেত তা উড়াত জুয়া খেলে। রাসেলা সরকারি স্কুলে পড়ত, বেতন দিতে হত না। তাই মা চাইত সে পড়ালেখা করুক। বড় হয়ে চাকরি করবে। তার মতো বাসায় বাসায় ঝিয়ের কাজ করতে হবে না। কিন্তু বাপ চাইত কোনও বড় লোকের বাসায় কাজে দিয়ে দিলে মাসে মাসে সেদিক থেকেও আরো কিছু টাকা আসবে। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যখন ঘরে ফিরত প্রায় প্রতিরাতেই এ নিয়ে লাগতো ঝগড়া। মারামারি। তাকে পড়ালেখা করানোর জন্য মা এত মার খেল, মার খেতে খেতে মরেই গেল, শেষ পর্যন্ত সে পড়ালেখা তার আর করা হয়নি। মায়ের মৃত্যুর পর বাবাও যখন তাদের ছেড়ে চলে গেল। ছোট দুটি ভাইবোনের জন্য, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে নেমে পড়েছিল জীবনযুদ্ধে। ঘরের সাথেই লাগোয়া ঘর জয়তুন খালার। খালা কাজ করে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। প্রস্তাবটি খালাই দিয়েছিল ফ্যাক্টরিতে কাজ করার। সঙ্গে সঙ্গে রাজি রাসেলা। কাজের সন্ধানে প্রথম যেদিন ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিল, সুপারভাইজার লোকটি কেমন করে জানি দেখছিল তাকে। রাসেলার একটুও ভালো লাগছিল না সে দৃষ্টি। অস্বস্তি লাগছিল তার। কি বিশ্রিভাবে তার দিকে তাকায়া থাইক্যাই জয়তুন খালাকে জিজ্ঞেস করছিল।
“এই মাইয়্যা কাজ করবো এইখানে ! বয়স তো অনেক কম মনে অয়” তারপর মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নিজের মনেই বললো।
“শরীরের গড়নটা বেশ খাসা! দুইদিনেই ডাগর হইয়া উঠব। কাল থেইক্যাই নিয়া আইসো কাজে।’’
ফ্যাক্টরি থেকে বের হয় জয়তুনকে বলে,
“খালা, লোকড়া কেমুন জানি! দ্যাখছ কেমুন কইরা দ্যাখছিল?”
“ওরা অমনই। এও কিছু দেইখ্যা পাইরবি না। কাম তো করন লাগবো। এইহানে না অইলে অইন্য কুনহানে। তুই ঘরে বইয়্যা থাকলে ভাই-বোন দুইডারে পালবো কে?” একটু পর আবার বলে, “ভালো কইরা ভাইব্যা দ্যাখ কি কইরবি?”
রাসেলা চুপ করে শুনে যায় খালার কথা। বাসে লোকের ধাক্কাধাক্কি খেতে খেতে যখন শহরের প্রায় শেষ প্রান্তে বস্তির ঘরটিতে এসে পৌঁছায়, তখন বিকেল প্রায় শেষের দিকে। জয়তুন খালা চলে যায় তার ঘরে। রাসেলাকে ঘরে ডুকতে দেখতেই টুনি রাজু দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। ভয়ার্ত চোখে জল তখনো টলমল করছিল।
“কই ছিলি বুজান? সারাদিন তোর দ্যাহা নাই। আমরা তো ভাবছি বাপ মায়ের লাহান তুই ও আমাগো ছাইড়া চইল্যা গ্যাছস ! “না রে! তোগো ছাইড়া বু’জানা কই যামু। কামের খোঁজে গ্যাছিলাম ! জয়তুন খালার লগে। “দু’জনকে বুকে জড়িয়ে ধরে উত্তর দেয়। বোঝা যাচ্ছে সারাদিন অনেক কেঁদেছে দু’জন। চোখগুলো ফুলে গেছে। রাসেলা দু’জনের চোখ মুখ মুছিয়ে দিতে থাকে যত্ন করে। “এমুন কইরা বইস্যা থাকলে আমাগো কেউ খাওন দিবো? কাম করন লাগবো না?
“তোমরা খাইছ?
“না। তোর লাইগ্যা বইস্যা আছি। তুই আইলে এক লগে খামু।” কান্নার যে রেশটি এতক্ষণ বুকভারী করেছিল টুনির কথায় তা যেন বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মত বের হয়ে এল। বস্তির ছোট এই ঘরটিতে ভাই-বোনের এই ভালোবাসা বাসি, অশ্রুজলে ভাসা চোখগুলো একে অপরকে মুছে দেয়ার দৃশ্য একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ দেখেনি। সারাদিনের অভুক্ত টুনি, রাজুকে আদর করে, নিজে গিয়ে খাবার নিয়ে আসে। আজ নিজ হাতেই খাইয়ে দেয় দুজনকে।
রাত কত হল কে জানে। তিন ভাইবোন পাশাপাশি শুয়ে। রাসেলা ভাবছে ওই ফ্যাক্টরিতে কাজে যাবে কিনা। লোকটির ‘চেহারা’ চোখে ভেসে উঠতেই ঘৃণায় রি রি করে উঠছে মন। রাজু হঠাৎ বলে উঠে
“বু’জান, তোর চাকরি তো হইয়্যা গ্যাছে। না?”
“হুম” আনমনে জবাব রাসেলার।
“কি মজা!আমরা অহন থেইক্যা ভালো খাইতে পারুম!” খুশিতে বিছানায় উঠে বসে রাজু। পাশে টুনিও।
সম্বিত ফিরে পেয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায়। খুশিতে উজ্জ্বল মুখটি। টুনিও আছে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেয়, যা হবার হবে। কাল থেকেই চাকরিতে যাবে। সেও উঠে বসে ভাইয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে
“হ ভাই, আর কষ্ট অইব না। ভালো খাইতে পাইরবি। দুইজনকে ভালো ভালো জামা কাপড় কিইন্যা দিমু। আমরা অনেক ভালো থাকমু। ঘুমা অহন।”
‘রাসেলা-যাইবি কামে? “জয়তুন খালার ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসে। দরজা খুলে খালাকে বলে,
‘হ খালা, যামু। একটু সময় দাও।”
তাড়াতাড়ি তৈরি হতে থাকে। টুনিকে ডেকে তুলে রাজুর দিকে খেয়াল রাখার কথা বলে, জয়তুন খালার সাথে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।
আবার সেই কুৎসিত হাসি মুখের সামনে দাঁড়িয়ে। কোথায় কাজ দেবে এখনো ঠিক হয়নি।
‘কিচ্ছু যখন জানে না হেলপারের কাজই করতে অইব। পারবো।” ‘হ স্যার। পারবো না ক্যান?’’ জয়তুন খালা রাহেলার পক্ষ নিয়ে বলে।
“যাও তাইলে, সুইং সেকশনে হেলপারের কাজ দেহাইয়া দাও।” আবার সেই লোলুপ দৃষ্টি রাহেলার দিকে।
ভয় ভয় করছিল রাসেলার। ঠিক মত কাজ করতে পারবে কিনা। ওখানে কাজ করা মেয়েগুলো কথায় কথায় গালি দেয়। হাসি টাট্টা করে। ওদের মধ্যে কেমন একটা একতা, কোথায় যেন মিল রাসেলা ঠিক ধরতে পারে না। প্রথম প্রথম গালি গালাজগুলো শুনলে খুব বাজে লাগতো। রাগ হতো। পরে আস্তে আস্তে বুঝেছে শুধু ওরা নয়, মাঝে মাঝে সাহেব ধরনের যে লোকগুলো কারখানা দেখতে আসে তাদের ভাষা আরো বাজে। চাকরির প্রথম দিকে কাজ থেকে ফেরার সময় একদিন খালাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
“খালা মাইয়াগুলান এমুন কথায় কথায় গালি-গালাজ করে ক্যান?”
“কয়দিন যাইলে তুইও ওগো লাহান করবি। কাম শুরু কর, বুইঝবি ক্যান গালি দেয়?”
“আমি ওদের লাহান হমু না”
জয়তুন হাসে ওর কথায়।
চাকরি হওয়ার পর থেকেই রাজু আর টুনি আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। চৌদ্দ বছরের রাসেলা যেন হঠাৎ অনেক বড় হয়ে গেছে। চাকরি ঘর দুটোকে কিভাবে একসাথে সামলে চলতে হয় ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে। প্রতিদিনের কাজগুলোর একটি অলিখিত রুটিন যেন নিজে থেকেই তৈরী হয়ে গেছে। ফ্যাক্টরিতে মাঝে মাঝে ওভারটাইম করায়, ফিরতে দেরী হয়-খুবই বিরক্তিকর সে সময়গুলো তখন মেজাজ আর ঠিক থাকে না। রাসেলা বুঝে যায় অনিচ্ছাকৃত জোর করে আদায় করা কাজের জন্যেই বিরক্ত হয়ে মেয়েগুলো ধীরে ধীরে বদলে যায়।
মাস শেষে যেদিন জীবনের প্রথম ইনকাম, বেতনের টাকা হাতে পেল, মনে হল এই দুনিয়ায় তার চাইতে ধনী আর কেউ নাই।
জয়তুন খালাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
“খালা, তোমার এই ঋণ কুনদিন শোধরাইতে পারুম না।”
“খালা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেছিল
“পাগলি, আমি তো পথ দ্যহাইছি। তোর মা খুব ভালা মানুষ আছিল। আমিও গরীব। এর থেইক্যা বেশী তোগো লাইগ্যা আর কি কইত্যে পারতাম?”
দুজনেরই মুখে হাসি, চোখে আনন্দের অশ্রু।
“খালা, চল কিছু কিইন্যা নিই। আইজ তুমিও আমাগো লগে খাইবা।”
জয়তুনের কোনও না শোনেনি। জোর করেই খালাকেসহ নিয়ে কিছু মিষ্টি, সস্তা একটা হোটেল থেকে বিরিয়ানি নিয়ে ফিরে আসে ঘরে। আজ ঘরে আনন্দের বন্যা বইছে। মনের আনন্দে টুনি আর রাজু যখন তৃপ্তির সাথে খাবারগুলো খাচ্ছিল তাদের অলক্ষ্যে চোখের জল মুছে রাসেলা কিন্তু জয়তুন খালার অভিজ্ঞ চোখ তা ঠিকই দেখে ফেলে। আজ খালার সাথে গল্প যেন শেষ হচ্ছে না। রাজু আর টুনি খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের দিকে তাকিয়েই জয়তুন খালা বলে,
“আইজ ওরা খুব খুশী। তাই না রে।”
“এওগুলান খালা। পেট ভইরা খাইল।”
একটু গম্ভীর হয় হঠাৎ গলার স্বর
“খালা?”
“কিরে?”
“খুশির জইন্য অনেক ট্যাহার দরকার নাই।
“কে কইছে। অহনো ট্যাহার গন্ধ চিনস নাই। হের লাইগ্যা এমুন কথা কস” হেসে বলে জয়তুন।
বিদায় নিয়ে খালা নিজের ঘরে চলে যায়। কিন্তু খালার কথাগুলো বাজতে থাকে কানে। বিছানায় শুয়ে নিজের মনকেই যেন প্রবোধ দেয়।
“খালা যত্তই হউক, আমি ট্যাহার পিছে ভাগুম না। “পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরে রাজুকে। সারাদিনের পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত শরীর বিছানার স্পর্শ পেতেই চোখ দুটো আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে আসে। তলিয়ে যায় ঘুমের দেশে।
কারো দুঃখ কষ্টের জন্য যদি পৃথিবী তার কক্ষপথে চলা বন্ধ করে দিত তাহলে হয়তো অনেক আগে বন্ধ হয়ে যেত দিন রাত হওয়া। পৃথিবীর এই চিরাচরিত নিয়মের সাথে চলতে চলতে রাসেলাও কিশোরী থেকে তারুণ্য অতিক্রম করছে। নেই আর সেই লাজুক, সংকোচে জড়ানো মেয়েটি। পরিবর্তন হয়েছে কর্মক্ষেত্রে কাজের অবস্থানও। সুইং অপারেটর এখন সে। যে খিস্তি, খেউড়কে সে ঘৃণা করতো কথায় কথায় ওগুলো এখন তার ভাষা। ওভারটাইম নিজে থেকেই করে বেশি টাকা পাবার আশায়। এসএসসি পাস করার পর টুনিকেও কাজ দিয়েছে তার ফ্যাক্টরিতে। লেখাপড়া সামান্য বেশি জানে। তাই অফিসে ম্যাসেঞ্জারের কাজ করে। রাজু নাইন পর্যন্ত পড়েই আর স্কুলে যায়নি। গাড়ি চালানো শিখে এখন সে ফয়সাল সাহেবের ব্যক্তিগত গাড়িটি চালায়। বস্তির ঘরে সে এখন আর থাকে না। মাঝে মাঝে ফয়সাল সাহেবের গাড়িটি নিয়েই দেখতে আসে রাসেলাদের। বসে না। কিছু দিলেও খেতে চায় না। বস্তির এই নোংরা পরিবেশে সে নাকি খেতে পারে না। রাসেলা ভাইয়ের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। টুনিও ফ্যাক্টরিতে তাকে এড়িয়ে চলে। জীবনযুদ্ধে লড়ে যাওয়া সৈনিক রাসেলার চোখ এড়ায় না তাদের এ পরিবর্তন। সেদিন কাজ শেষে তিনজন একসাথে বাসায় ফিরবে বলে যখন অফিসে গেল, ওকে দেখেই টুনি কিছুটা রাগত: স্বরেই বলল,
‘তুমি এইখানে! কেন আসছ?’
‘কাম শেষ। ভাবলাম তিনজন এক লগে যাই। তাই আইলাম তোরে ডাকতে!’
‘আমার দেরি হইব। তুমি জয়তুন খালার লগেই চলে যাও। এভাবে এইখানে আর আসবা না’
টুনির আচরণে চোখ দিয়ে পানি চলে আসে রাসেলার। ফেরার সময় খালা সান্ত্বনা দেয়।
‘দুনিয়া এমনই। মিছাই কষ্ট পাইতেছস! এইবার নিজের কথা ভাব। ওদের মানুষ কইরা দিলি। এইবার ওদের রাস্তা ওরাই চিইন্যা লইব।’ খালার কথায় অশ্রুর ধারা আরো বেগবান হয়। খালাকে বলতে পারে না কাজে যোগদানের পর সুপারভাইজারের বিশেষ দৃষ্টি ছিল তার উপর। তাকে কাজ শিখানোর জন্য শিখাকে বলে দিয়েছিল। মাত্র চার-পাঁচ মাসেই শিখে ফেলে মেশিনের কাজ। ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে সুপারভাইজারের সাথে। অনেকে সরাসরিই কটাক্ষ করতো তাদের সম্পর্ক নিয়ে। শিখাই একদিন বলে,
‘টুনির কতা কিছু শুনছস?’
‘কি কথা? কি হইছে’ উদ্বিগ্ন রাসেলা
‘তোর সুপারভাইজার! হের লগে পিরিত করে’ রাসেলা বিশ্বাস করতে চায় না। শিখাই অন্য একদিন রাসেলাকে নিয়ে গিয়ে দূর থেকে দেখায় টুনির কাঁধে হাত রেখে গল্প করছে সুপারভাইজার। খালার কাছে এসব বলা যাবে না। লজ্জা লাগে বলতে তার বোনই তার ভাবনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আজ প্রথমবার মনে হয় শাওনই ভালো ছিল। কাটিং মাস্টার। কিন্তু সুপারভাইজারের বউ হতে পারলে টাকা, আর সম্মান দুটোই বাড়বে তাই পাত্তা দেয়নি শাওনকে। সেদিন টুনি ঘরে ফিরেছিল একটু বেশি রাত করে। দু’একটা কথা ছাড়া ভাবে হয় দু’বোনের মধ্যে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে টুনিকে কাপড়-চোপড় গোছাতে দেখে জানতে চায় রাসেলা।
‘কুনহানে যাইবি না কি?’
‘বুবু তোমারে বলা হয়নি। কাইল আমরা বিয়া করছি। বাসা দেইখ্যা আইলাম। আমি আর ইউসুফ’ কারখানায় চাকরি পর থেকেই ‘বু’ থেকে ‘জান’ বাদ দিয়ে আরেকটি ‘বু’ যোগ করেছিল টুনি।
‘আসমান কি খইস্যা পড়লো নাকি? এত্ত বড় শব্দ কিসের অইল? বোবা রাসেলা বুঝে না এ তার হৃদয় ভাঙার শব্দ। কেউ শোনেনি। শুধু সেই শুনেছে। ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সারারাত দাওয়ায় বসেই কাটাল। টুনি একবারও ডাকেনি ভেতরে যেতে।
পরদিন। ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া গাছের মত শরীরটাকে জোর করে টেনে ফ্যাক্টরিতে যায়। শিখা চমকে উঠে তাকে দেখে।
‘কি হইছে? এমুন হইছস ক্যান? তোর শরীর ঠিক আছে তো?’ রাসেলা আজ আর কাঁদে না। খুব নরম স্বরে জবাব দেয়, ‘সবই ঠিক আছে। আজই আমার খুশির দিন। আমার বইন বিয়া বইতাছে সুপারভাইজারের লগে।’
“কি! তোর বইন তোর লগে এমুন বেঈমানী কইত্যে পাইল্যো?” শিখা এতবড় করে কথাগুলো বলেছিল আশে পাশে কয়েকজন মেয়ে মেশিন থেকে উঠে এসে জড়ো হল রাসেলার কাছে। সবাই সেদিন নানাভাবে সান্ত্বনা দিয়েছিল। শাওনও এসেছিল খবর শুনে।
সব ক্ষতই শুকায়। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়েছিল রাসেলা। অশান্ত মনও এক সময় শান্ত হয়ে বসলো কাজে। বছর গড়িয়ে আরো দুই তিন। জয়তুন খালার সাথে, সুখ-দুঃখের কথা শোনার সাথী হলো আরো একজন শাওন। রাজু আর টুনির সাথে এখন আর তেমন দেখাও হয় না। কদাচিৎ খবর নেওয়ার জন্য রাজু আসে বস্তির ঘরটিতে। বিয়ের পর টুনি কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। প্রথম প্রথম মাঝে মধ্যে এক দুবার আসত। বাচ্চা হওয়ার পর আর আসেনি। সেদিন শাওন একরকম জোর করেই নিয়ে গেল ঘুরতে। পার্কের বেঞ্চে পাশাপাশি বসেছিল দু’জন।
“বয়সতো অনেক হইল। নিজের কথা কিছু ভাবছ?’
সারাজীবন তো ভাবলাম। অন্যের কতা। অহন চাই আমার জইন্য কেউ ভাবুক।” হাসে রাসেলাযদি আমি ভাবি?
পারবা। হাচা কইতাছ।
হ। আইজ রাইতেই মার লগে তোমার কতা কমু। মায়েরে রাজি করায়া তোমারে বিয়া করুম।
তোমার কি মনে অয়? তোমার মা রাজী অইব? সংশয় রাসেলার কন্ঠে
ক্যান অইব না। না অইলে আমরা নিজেরাই বিয়া কইরা ফালামু। কিছুটা জোরের সাথেই বলে শাওন।
রাসেলা আমি দ্যাখেছি তোমারে অনেক কষ্ট পাইতে। আমি তোমারে আর কষ্ট কইত্যে দিমু না। অনেক সুখে রাখমু তোমারে। কথা ছিল না রাসেলার মুখে। শাওনের কাঁধে আলতো করে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। অনাগত ভবিষ্যতের সুন্দর দিনগুলোর কথা ভেবেই হয়তো গড়িয়ে পড়েছিল ক ফোঁটা অশ্রু।
পরদিন কাজে যাওয়ার সময় জয়তুন খালা তার পরিবর্তন লক্ষ্য করে। কেমন যেন অস্থির ! আজ অনেক বছর পর নিজেকে যত্ন করে সাজিয়েছে। ফ্যাক্টরিতে পৌঁছেই তার অনুসন্ধানী চোখ খুঁজে শাওনকে।
ওই তো। শিখার লগেই তো কতা কইতাছে ! দুরুদুরু বুকে সেদিকে পা বাড়ায়। রাসেলাকে আসতে দেখে শিখা সরে যায়। শাওন গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। মনে মনে ঘাবড়ে যায় তবুও সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করে
কি অইছে? তোমারে এমুন গম্ভীর দেখায় ক্যান?
শাওনের ইতস্ততঃ ভাব দেখে রাসেলার উদ্বেগ বাড়তে থাকে আরো।
কতা কওনা ক্যান? বলো কি অইছে?
মারে রাজ করাইতে পারি নাই। “কয় ফ্যাক্টরিতে কাম করা মাইয়াগুলান ভালা না”
তুমি কি কইলা? উৎকন্ঠিত রাসেলা
কাইল সারা রাইত মা কাঁনছে। কইছে যদি আমি তোরে বিয়া করি গলায় দড়ি দিব। জীবনে আমার মুখ দ্যাখাবো না
তুমি মাইন্যা নিলা মার কতা। এবার একটু কঠিন রাসেলার সুর, দ্যাখ আমার বাপ নাই। ভাই গুলান মায়েরে দ্যাহে না। আমিও যদি এই কাম করি…. থেমে যায় শাওন
যেন আর কথা নেই। দু’জনেই নীরব। রাহেলা ভাবে, এইডাই কি হেই মানুষ যে গতকাইল এও জোরের লগে কতা কইছিল? তারে স্বপ্ন দ্যাহাইছিল? মনে পড়ে যায় বাপের কথা। মা মরতে না মরতেই যেই লোক আবার বিয়া কইরা সংসার পাতলো আরেক মাইয়ার লগে। হঠাৎ করে সব মানুষের উপর ঘৃণা বোধ করে। সবগুলোই বেঈমানের জাত। হুদা চেহারা ভিন্ন হেগোর।
সেদিন ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে আর ঘরেও যায় নাই। বসেছিল দাওয়ায়। জয়তুন খালা সব শুনেছে শিখার কাজ থেকে। নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক পীড়াপিড়ি করছিলো। যায়নি সে। পোড় খেতে খেতে শুকিয়ে গেছে চোখের পানিও।
কখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত গভীর হয়েছে টেরও পায়নি। বস্তির ঘরগুলোতে সাড়াশব্দ নেই। ক্লান্ত মানুষগুলো ঘুমে অচেতন। আকাশে অনেক তারা। সেদিকে তাকিয়ে রাসেলা ভাবে
আবার ভোর অইব। আরেকটি নতুন দিন শুরু অইব। হঠাৎ দেখে আকাশ থেকে একটি তারা খসে পড়েছে। চমকে উঠে রাহেলা। ওই তারাটি কি আমি? খইস্যা পড়লো ক্যান? তাইলে কি তারে আর দরকার নাই আকাশের? যেমন আমারে আর দরকার অয়নি টুনি আর রাজুর? হেই মা মরার পর থেইক্যা কেবল ছুটছি আর ছুটছি। আইচ্ছা! দিন গুলানরে আবার পিছনের দিকে নেওন যায় না। তাইলে আরেকবার হাইট্টা আসতাম জীবনের পথ ধইরা। সব ভুলগুলানরে শোধরাইয়া! নিজের জইন্য একটু স্বার্থপর হইয়া? আছে? আছে কি কোন পথ পিছনের দিকে যাইবার?
Read More: রবিবারের ছোটগল্প পাখি হওয়ার সাধ লিখেছেন চন্দ্রশিলা ছন্দা

Check Also

গল্প

রবিবারের ছোটগল্প চাঁদ ছোঁয়ার গল্প লিখেছেন সাগরিকা রায়

ছোটগল্প Illustration: Preety Deb কচু গাছের আড়ালে দাঁড়ালেও চান্দু নিজেকে বেশ লুকোতে পারে।গজু বলে, ভাই …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *