ইয়ে বিভ্রাট
জ য়ি তা সে ন গু প্ত
ছবি: প্রীতি দেব
১.
“আরে বাবা,আমি বলছি তো! সিস্টেম সবই এক।শুধু ইয়েতে লেখা থাকেনা ওইটা,এইটাই সুবিধা…” মামুর আশ্বাসবাক্যে বুক থেকে দুশ্চিন্তার পাহাড় নেমে গেল পিউর। মামু ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা করে,এখন ওখানকারই অধ্যাপক। সুতরাং তার দেওয়া তথ্যে কোনও ভুল থাকার কথা নয়। আজ পিউ এর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্সের ফর্ম তুলতে যাওয়ার কথা। সদ্য গ্র্যাজুয়েট পিউকে তাই শরনাপন্ন হতে হয়েছিল এই সবেধন নীলমনি মামাটিরই।ছোট থেকেই ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল পিউয়ের।মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিকে মার্কস ও নেহাত খারাপ না পাওয়ায় গ্র্যাজুয়েশানে ইংরেজী অনার্স পেতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি তার।কিন্তু স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমের তারতম্যটা বুঝতে বুঝতেই ঘাড়ের কাছে এসে পড়ল পরীক্ষা।এবং ফলস্বরূপ যা হবার তাই হল।কিছুটা ভাগ্য আর কিছুটা দুরদৃষ্টি এবং অধ্যাবসায়ের অভাবে অনার্সকে বিদায় জানিয়ে পাসকোর্সেই হতে হল গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু এবার নিজের সেই অপূর্ন সাধ পূরণ করতে আদাজল খেয়ে লেগেছে পিউ।ইদানীং দুরশিক্ষার চল হয়েছে খুব।সেখানে ভর্তি হতে গেলে নাকি অনার্স নিয়ে পাস না করলেও চলে। মাসে একদিন বা দুদিন ক্লাস করেই ফাইনাল পরীক্ষায় বসা যায় আর পাস ও নাকী করা যায় ভাল ভাবে।পিউয়ের এক বন্ধুর দিদিই তো এই ভাবে পাস করে এখন ভাল চাকরী করছে।তাই পিউ ঠিক করেছে,দুরশিক্ষা প্রতিষ্ঠান মারফৎই ইংরেজী নিয়ে পড়াশোনা করবে।মামুও খুব উৎসাহ দিচ্ছে এই ব্যপারে।ফলে পিউয়ের আত্মবিশ্বাসও তুঙ্গে। আজ ফর্ম জমা দেওয়ার শেষ দিন।তাই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে থিকথিকে ভীড়।বাবার সঙ্গে প্রায় শ-খানেক ছেলেমেয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো পিউ।সামনে,পেছনে দাঁড়ানো অপরিচিত মুখেরা নিজেদের মধ্যে বন্ধু জুটিয়ে গল্পে মত্ত।চেনা মুখের অভাবে তাদের সাথেই টুকটাক কথা বলতে লাগলো পিউ। সকাল সাতটায় লাইনে দাঁড়িয়ে,বিকেল পাঁচটা নাগাদ যখন পিউ বাড়ী ফিরল,তখন তার শরীর বিধ্বস্ত হলেও মনে নতুন আশার কলি।আজ থেকে শুধু স্বপ্নের পথ ধরে লক্ষ্য অভিমুখে এগিয়ে যাওয়ার পালা।
২.
দুপুর দুটো- ঠা-ঠা রোদ্দুরে জনা পঞ্চাশেকের পেছনে তীর্থের কাকের মত দাঁড়িয়ে আছে পিউ।কিন্তু রেজাল্ট বা রেজাল্ট-বিতরনকারীর এখনও পাত্তা নেই।আরও কতক্ষণ এই কাঠফাটা রোদ্দুরে দাঁড়াতে হবে কে জানে- গত সপ্তাহে এম.এ. ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে পিউয়ের।যথেষ্ট ভাল নম্বর নিয়েই পাস করেছে সে।আজ মার্কশীট হাতে পাওয়ার পালা। চারটে নাগাদ হাতে মার্কশীট পেয়েই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল পিউয়ের।ব্যপারটা কী হল?এ কি সর্বনেশে কান্ড!আশেপাশের বন্ধুবান্ধবদের মুখে চোখে বিস্ময়ের লেশমাত্রও নেই।তাদের কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেল না পিউ,পাছে বোকা বনতে হয়।মার্কশীট নিয়ে সে চুপচাপ ফিরে এল বাড়ীতে। বিকেলে মামুর রেজাল্ট দেখতে আসার কথা।চটি খুলে ঘরে ঢুকতেই তাকে চেপে ধরলো পিউ,“এটা কী মামু?” পিউয়ের মেলে ধরা রেজাল্টটায় চোখ বুলিয়ে মামু উচ্ছসিত গলায় বলে উঠল,“ব্রাভো!তুই তো কাঁপিয়ে দিয়েছিস রে!” “আর আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছ তুমি!” কাঁদোকাঁদো গলায় বলে উঠল পিউ, “মানে?” “এটা কী?” রেজাল্টের একটা বিশেষ অংশের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করল পিউ।সেখানে জ্বলজ্বল করছে একটা হৃদয়-বিদারক শব্দ। ‘ডিস্ট্যান্স!’ “তুমি যে বলেছিলে রেজাল্টে ডিস্ট্যান্স কথাটা লেখা থাকে না,তাই সেটাকে রেগুলারের মত ধরা হয়?” “আমি?”,মামু যেন আকাশ থেকে পড়লো,“আমি কবে একথা বললাম?” “তার মানে?”,আঁতকে উঠলো পিউ,“তুমিই তো বলেছিলে ‘ইয়েতে লেখা থাকেনা ওইটা!”।আমার স্পষ্ট মনে আছে…” “হ্যাঁ-কিন্তু সেটা তো রেজাল্ট নয়!সার্টিফিকেটের কথা বলছি।দ্যাখ্,ওটাতে লেখা নেই।” পিউ সার্টিফিকেটটা বের করে দেখল,সত্যি তাতে ডিস্ট্যান্স কথাটার উল্লেখ নেই। “কিন্তু তুমি যে বললে ইয়ে…?” “তা আমার ‘ইয়ে’টাকে তুই রেজাল্টই বা ভাবলি কেন? আর তোর যখন কনফিউশন হচ্ছিল,তুই ক্লিয়ার করে নিবি না?” ‘কনফিউশন আমার হয়নি’,বলতে গিয়েও বলতে পারল না পিউ।মামু তার রেজাল্টের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর দিচ্ছে,এটাই ভেবেছিল সে।এখন বোকা বনে গেছে। “দুঃখ পাস না,”,টপ্ করে প্লেট থেকে একটা রসগোল্লা মুখে পুরে সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলে উঠল মামু,“ভ্যালু সব কিছুরই এক।চাকরী তো পরীক্ষা দিয়েই পেতে হবে।নম্বর দিয়ে কিছুটা হয়,সবটা তো নয়! নে,মিষ্টি খা। এত ভাল রেজাল্ট করেছিস…” ভাগ্নীর হাঁ হয়ে যাওয়া মুখে সস্নেহে একটা রসগোল্লা পুরে দিল মামু। ভগ্ন হৃদয়ে মিষ্টি চিবোতে চিবোতে পিউ প্রতিজ্ঞা করল,আর কোনওদিন মামুর মত কোনও ‘ইয়ে’র উপর ‘ইয়ে’ মানে,ভরসা করবে না। ইয়েটা-, মানে,রসগোল্লাটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল মুখের মধ্যে।
আরও ছোটগল্প: রবিবারের ছোটগল্প যুগান্তর মিত্র-এর ‘ঠাকুরদা’