কবিতা
ছবি: অনির্বাণ পাল
দেবাশিস সাহা-এর আটটি কবিতা
মা
মা রান্নাঘরে
বাড়িময় ধোঁয়া আর চোখের অসম লড়াই
ভিজে যাওয়া সময়ের সাঁকো
পায়ে লেগে থাকা
মায়ের সাবধানতা
একটু আড়াল
অমনি ঈশ্বরের কাছে আবদার
ঈশ্বরের কি মা আছে
আছে দুগগা দুগগা, বালাই ষাট বলার
কথা বলা পুতুল
মা কথা বলে
অনর্গল, যেন বৃষ্টি
থামার নাম নেই
তাই আমিও এখনও চলমান
আমার সারা শরীরে মা মা গন্ধ লেগে
আমাদের মা
ফুটো হয়ে গেছে রাত
ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আলো
গলগল করে বেরিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার
ফুটো দিয়ে দেখা যাচ্ছে
আমাদের গোপন তারা
জনমভর সেই ফুটো সেলাই করার
চেষ্টা করছে আমাদের মা
বাবা
রৌদ্রে সাঁতার কাটা কৃষক
আমার বাবা
ঘর করছে পক্ষাঘাতের সঙ্গে
দিন-রাত বিছানার সঙ্গে কথা
সমস্ত ব্যথা বিছানার সঙ্গে ভাগ
ফসলের গন্ধ-মাখা ভোর কাঁধে নিয়ে
বাবা ফিরতো
বাবার শাসনের ফাঁক দিয়ে
আমি উঁকি দিতাম ভিডিও হলে
বলিউড রং করতো আমার কৈশোর
গাছে গাছে পাতার ভিড়
ভিড় ঠেলে
বাবা আমাকে দেখাতো
মৌমাছিদের পাড়া
আমি তখন মধুময়
বাবা ঘর করে পক্ষাঘাতের সাথে
দিদি
শাসন আর সোহাগ দিয়ে
আমাকে রং করতো দিদি
কখনো পাল্লা
কখনো স্নেহ
কখনো হার-কখনো জিৎ
বারো মাসে তেরো নালিশ মায়ের কাছে
কত শাপ-কত শাপান্ত
কেউ কথা শোনেনি
গাছেরা বধির
বধির বলেই কালা
দিদি নিজে নিজেই
একদিন গাছ হয়ে গেল
বটগাছ
কত আশ্রয় কত ছায়া
কখনো কখনো আকাশও কি নেমে আসে
দিদির কাছে
বাতাস হয়ে
পালক হয়ে
ডিম হয়ে
ভাই
মার্বেল গুনতে গুনতে
শতকিয়া শিখলাম ভাইয়ের কাছে
ছোট ভাই
গুলতি হয়ে দৌড়
আর মাছ ধরার সময়
যেন মৌন ঋষি
ফুটবল মাঠে
আমি বারো নম্বর
ভাই বল নিয়ে দৌড়
গোলের দিকে
গোলপোস্ট কোথায়
চতুর্দিকে শুনশান
আর ধু ধু অন্ধকার
রাস্তাগুলো শুয়ে আছে মড়া হয়ে
ভাই কি তবে শ্মশানবন্ধু
কাঁধে ভারতবর্ষের লাশ
চাঁদ কি টের পায় লাশপোড়ার গন্ধ
হ্যালো, মাধুদি
এখানে নদীর ভীষণ অসুখ
গাছেরা এখানে দিনরাত ঝগড়ুটে
জানো মাধুদি, ভয় করে
চারদিকে গন্ধময় মুখোশের ভিড়
ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হাত নষ্ট করে আমাকে
হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি
বৃষ্টি এসে ধুয়ে যায়
দুর্গন্ধযুক্ত গাছেদের মুখ
বৃষ্টি চলে গেলে
সারারাত ধরে বৃষ্টির কি নাচ
ভয় করে, ভীষণ ভয় করে মাধুদি
এখানে গাছের দুরারোগ্য ব্যাধি
নদীরা এখানে ভীষণ অসহায়
ভাদু-দা
লম্বা ঢ্যাঙা গাছ হয়ে
আমার সামনে দাঁড়াতো ভাদু-দা
ভাদু গান আমি শুনিনি
সেই গাছের চওড়া কাঁধে বসে
শুনেছি আলকাপ-পঞ্চরস
পথ চলতি সমস্ত মানুষকেই
মনে হয় ভাদু-দা
সেই বিশ্বস্ত কাঁধ
আর চওড়া বুকে অনেক প্রশ্রয়
খুচরো পয়সাকে রং করে চাঁদ বানাতো
আর আমি পিঠের উপর বসে
জোর চিৎকার
চল্ বাসন্তী
রেণু পিসি
স্টেশনের পায়ের কাছে
রেণু পিসির বাস
যেতে আসতে পিসির সঙ্গে দেখা
দেখা হলেই
দেখা হলেই কথাগুলো
পেয়ে যায় মাছজন্ম
তিড়িংবিড়িং -যেন খই ফুটছে
ততক্ষণে সময় ছুটেছে ট্রেনের আগে আগে
পিসি খোঁজ নিচ্ছে আমাদের আলো-অন্ধকারের
স্টেশনের পায়ের কাছে পিসির ভিটে
তার অদূরে জমি চাষ করে বাবা
ট্রেন জল নিতে এসে
শুনে যায় ভাই-বোনের গল্প
[আরও পড়ুন: রাজস্থান ভ্রমণ : জয়সালমীর থেকে কুলধারা একটি ভৌতিক নগরী]
অশোক ঘোড়ই-এর কবিতা সিরিজ
শহর ছাড়ার দিন
১.
শহরের চোখে ঘুম নেই
দূরে চলে যায় দূরের বন্ধুরা
ও সকাল,বলে দিও
আমার বন্ধুকে
আমি চলে যাচ্ছি তার
শুভেচ্ছাবার্তা ছাড়াই
২.
ও হাওয়া,তার কানে আলতো মুখ রেখে বলো: ছেড়ে যাচ্ছে বন্ধু তার
ও হাওয়া, থাক,জাগিও না তাকে আর
ও হাওয়া, দ্যাখো,তার জন্য পাখিরা তাদের ডানা ভিজিয়েছে
তবু,সে ওঠেনি
ও হাওয়া, বলো তো আমায়
সে কেমন ঘুমিয়ে রয়েছে
৩.
ও হাওয়া, তোমাকেই চুপিচুপি বলি,
লাল ওড়নায় তাকে দারুণ মানিয়েছে
ও হাওয়া, পাঁচকান করো না যেন,
তার সামান্য ছোঁয়ায় পাখিদের উড়ান বেড়েছে
ও হাওয়া, জেনে রেখো, তার চোখে চোখ রেখে শহরের নিদ উড়ে যায়
ও হাওয়া, চাঁদ শুয়ে আছে অনন্ত কুঁয়ায়
ও হাওয়া, গোল জলে জোৎস্না ভরেনি
ও হাওয়া, জানো,আমার বন্ধুতাও সে
ঠিকঠাক কবুল করেনি
৪.
ও হাওয়া, বলো তাকে:
তার দিন শুভ হোক
আমি তো বাইরের লোক
কোন অধিকারে বলি:
তোমার ছোঁয়ায় সুফিদের
দিন শুরু হোক
ও হাওয়া, বলো তাকে:
তার দিন শুভ হোক
৫.
ও হাওয়া, বলো তাকে,
আমি পৌঁছে গেছি আমার শহরে
তার শহরে এখনও সকাল ফোটেনি
চায়ের ধোঁয়ায় তার শরীরের গন্ধ
লেগে আছে এখানেও
ও হাওয়া, এ সামান্য পেয়ালার
সমুদ্র জোটেনি
৬.
ও হাওয়া, আমি জানি,আমার সামান্য অক্ষরই আমাকে মেরে ফেলবে
ও হাওয়া, কী করি বলো তো,অক্ষরেরা
সত্যই ধারণ করে শুধু
মিথ্যা তারা ছুঁয়েও দেখে না
বন্ধু শুধু বন্ধুমাত্র নয়
অক্ষরেরা সব জানে
বোঝালেও অন্য কিছু বোঝে না
ও হাওয়া, তুমি তো জানো,এ জীবনের আর কোনও উপায় নেই
সত্য লিখে যাওয়া ছাড়া
হৃদয় আর কী পারে,
আততায়ীর হাতে নিজেকে
সঁপে দেওয়া ছাড়া
[আরও পড়ুন: উড়িষ্যা ভ্রমণ করতে চার দিনের ছুটিতে বেরিয়ে পড়লাম]
দেবজ্যোতি কর্মকার-এর দুটি কবিতা
নাটকের শেষদৃশ্যে
শেষদৃশ্যে একটা ঝড় হবার কথা
কথা ছিল : সব তছনছ হবে
তারপর আগের মতো রোদ উঠবে
শেষদৃশ্যে একটা খুন হবার কথা
কথা ছিল : কেউ একটা গুলি চালাবে
প্রচণ্ড শব্দে মাথাটা এফোঁড় ওফোঁড়
নাটকের শুরু থেকেই মঞ্চে একটাই সিংহাসন
আমি তাতে ধুলো জমতে দিইনি
শেষদৃশ্য আমি দেখব বলে
সিংহাসনে রাজা এলেন
আমার সাথে কথা হল:
চোখ রাঙালেন
তর্ক-বিতর্ক
শেষে আমাকেই নির্বাসনের হুকুম দিলেন!
নাট্যকার শেষদৃশ্যকথা এভাবেই লিখলেন :
কীভাবে শেষদৃশ্যে সিংহাসন নড়ে ওঠে একাই
নাটকের একেবারে শেষে কেউ না কেউ
নির্বাসনে যায়!
যুদ্ধের পোশাক
প্রত্যেকেই জেনে গেছি এযুদ্ধে পরাজয় ছাড়া কিছু নেই
অথচ,
শানিয়ে নিচ্ছি অস্ত্র!
চোখ বাঁধা,
-কাকে খুন করতে হবে জানিনা কিছুই
কেউ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয় এখন
অসহায় হয়ে তবু রাস্তায় রাস্তায়
গর্জন!
দূরে এককোণে যেখানে সকাল সন্ধ্যায় জড়ো হয় সবাই
সেখান থেকেই নেশার মতো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারিপাশে
তারপর,
অস্ত্র হাতেই ছুটছি কেবল
এযুদ্ধে কেউ জেতেনি কখনও
যুদ্ধের পোশাক পরে হাঁটছি তবু!
আরও দেখুন: রবিবারের ছোটগল্প প্রতিপক্ষ লিখেছেন পূজা মৈত্র