দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মন্দির, মসজিদ, দর্গা। এছাড়া আরও অনেক ধর্মাবলম্বীদের ধর্মস্থান। এইসব জায়গাগুলি নিয়ে মানুষের মনে সঞ্চিত আছে প্রবল বিশ্বাস আর অগাধ শ্রদ্ধা। এমনকি এই স্থানগুলি নিয়ে প্রচলিত আছে নানান মিথ। ফাল্গুনী ঘোষ লিখলেন এমনই একটি জনপ্রিয় মন্দির সম্পর্কে কিছু অজানা কথা।
কখনও কখনও বড় রাস্তা ছাড়িয়ে মাঠের বাঁকে কাঁচা পথে হাঁটলে অনেক কথারা উড়ে বেড়ায়। কত ফিসফাস। গাঁ গঞ্জের প্রাণের কথা। হৃদয় লুকানো থাকে সেখানে।
সেরকমই এক গ্রাম সন্তোষপুর। বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকে এই গ্রামের ঠিকানা। লোকমুখে হাটপাড়া জোঘাড়। আজ একবিংশ শতাব্দীতে যেখানে কোনো আধুনিক যান চলাচল নেই সেখানে আলীবর্দি খানের আমলের হাল কি ছিল তা কাল্পনিকতার ঘেরাটোপে অনেকটাই। তবুও ঘোড়া ছুটিয়ে সুলতান আসতেন তাঁর জমিদারি দেখতে। রাম রায়চৌধুরী। গ্রামের সরলসিধা মানুষজন ‘রাজা’ নামে তাকে মাথায় তুলে রাখে।এখন সে রামও নেই, রাজত্বও নেই। পড়ে আছে গ্রামের বটতলার সন্ধ্যার ঠেক, আর অতি প্রাচীন জুগুদ্দে মায়ের মন্দির। প্রতি সন্ধ্যা সেখানে টিমটিমে কিন্তু বছর শেষে চৈত্র সংক্রান্তির দিন সাজো সাজো রব।এই নিয়েই কথা হয়, গ্রামের বয়স্ক থেকে নবীন ছোকরা সকলের মধ্যেই। সাক্ষাৎ দুগগা মা বলে কথা। উনি তো জগৎজননী। কারই বা অত বড় বুকের পাটা আছে, যে অমান্য করবে। মন্দিরের পাশ দিয়ে গেলেও কপালে হাত ছোঁয়ায় সবাই।
না মেনে উপায়ও নেই, ঘটনা তো চোখের সামনেই। ফজল শেখ প্রতি চৈত্র সংক্রান্তিতে নিয়ম করে মুরগী বলি দিয়ে যায় মা’কে। কেতাবাজ ছেলের চাপে সেবার আসতে পেল না মায়ের থানে। উৎসবের দিনে চোখের জল ঝরল। হুজ্জুতি করে সেই যে ছেলেটা বেরিয়ে গেল! ঘরে এল, একমাস পর চিরকালীন পঙ্গুত্ব নিয়ে। সাধের মোটরবাইকের অবস্থা বলবার মতো নয়।গ্রামের বয়স্ক মুরুব্বির কথকতা শুরু হয় এরপর। কবে কোন শাঁখারি তার ছোটো শাঁখা-পলার বাক্সটি হাতে ঝুলিয়ে নাকি ফিরছিল। দ্যাখে রাস্তার ধারে পুকুর পাড় আলো করে সাঁঝবেলায় এক এয়ো বসে। “ও শাঁখারি, আমার হাতের শাঁখা ভেঙে গেছে, হাত খালি। পড়িয়ে দেবে একজোড়া শাঁখা?” শাঁখারি পড়ে মহা দুর্ভাবনায়। এর কাছে টাকা পয়সাও নেই! আবার খালি হাত এয়ো শাঁখা পরতে চাইলে তাকে ফেরানোও উচিত নয়। শাঁখারির দুর্ভাবনায় হেসে ফেলে রমনী। “রাজা রাম রায়চৌধুরী আমার বাবা। উনার কাছ থেকে চেয়ে নিলেই হবে। গিয়ে বলবে আপনার মেয়ে জগদ্ধাত্রী শাঁখা পরেছে”।
আশ্বাসবাণী আর নাম সম্বল করে শাঁখারি রাজার দরজায় হাজির হয়। কিন্তু রাজা তো প্রমাণ চান। প্রমাণ ছাড়া টাকাপয়সা দিয়ে দেবেন তেমন বোকা মানুষ তিনি নন। কে-ই বা বলতে পারে শাঁখারি ঠগ নয়!
সুতরাং সেই পুকুরপাড়ে রাজসমাগম ঘটল। কিন্তু কোথায় মেয়ে! ঘাট যে ফাঁকা! এবার তো রাজা তাকে ঠক ভেবে শাস্তি দেবে! কে ছিলে তুমি মা, কোথায় ছিলে। হে ভগবান, আমার সত্যি কিভাবে প্রমাণ করব? ভক্তের অপমান ঈশ্বর কখনও সইতে পারেন না। পুকুরের গভীর জলদেশ থেকে মা জগদ্ধাত্রী শাঁখা পরা জোড়া হাত তুলে শাঁখারির অপমান বাঁচালেন। রাজা রাম রায়চৌধুরী পুকুর পাড়ে পাকা বসতবাটি দিলেন তাঁর বিশ্বজননী জগদ্ধাত্রীকে। ইনিই কালের ক্ষয়ে ‘জুগুদ্দে মা’।
এ কথকতা আজো বেঁচে আছে কানে কানে। সবার গায়ের রোম খাড়া হয়ে ওঠে মনে করলে। গ্রামের যে যেখানেই থাক চৈত্র সংক্রান্তির দিন সকলে এসে জড়ো হয়। মায়ের পুকুরে স্নান করলে সব অসুখ সারে যে। মনের অসুখ, শরীরের অসুখ। মানসিক থাকে নানান সম্প্রদায়ের। হিন্দু-মুসলমান ছুঁৎমার্গের উর্দ্ধে তিনি যে ‘মা’। যার যেমন সম্বল তেমন দিয়ে মাকে ভক্তিভরে ডাকে বৎসরান্তিক মিলনোৎসবে। মেলা বসে। জিলিপি, পাঁপড়, রসগোল্লার রসে মন মাখামাখি হয়। ঈশ্বর আসেন মানুষের মাঝে। মিলন ঘটে। মহামিলন।
আরও পড়ুন: তীর্থ যাত্রা ডট কম লিখেছেন যশোধরা রায়চৌধুরী