জুবিন ঘোষ
ছোটবেলায় ঠাকুমা একটা ছড়া পড়ে শোনাতেন, “বৈশাখ মাসে পুষেছিনু একটি শালিক ছানা / জ্যৈষ্ঠ মাসে উঠল তাহার ছোট্ট দুটি ডানা।” আমার কিন্তু বোশেখ মানেই পোষবার মাস মনে হয়। ব্যবসাদার দোকানদান পয়লা বৈশাখ শুরু হতেই নতুন হালখাতা পুষবে। হালখাতা পুষতে নতুন করে আরও কিছু ধারদেনা মিটিয়ে, আবার নতুন খোদ্দের পুষবে। যতই ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার, হ্যাপি নিউ ইয়ার’ করে চিল্লামিল্লি কেক কাটাকাটি আর আলোকিত পার্ক স্ট্রিটে ‘সম্প্রীতি আর সংস্কৃতি বাঁচাও’ শঙ্খ ঘোষের পিছু পিছু মহামিছিলে যোগ দেওয়া বিজ্ঞজনেদের চেয়েও বেশি ভিড় করুক না কেন বাংলা দিনলিপিতে কোন মাসে কতগুলো দিন আছে তা না-জেনেই পয়লা বৈশাখ হিরিখ খেয়ে ট্রাডিশনাল বাঙালিরাও নতুন করে জামাকাপড় কিনে একলা বৈশাখ থেকেই সেগুলো পোষা শুরু করবেন। দোকানে দোকানে নতুন মাটির গণেশ পুষবেন।
এইসময় সাড়ে পোয়া বারো লেখকদের। পয়লা বৈশাখ মানেই কলেজস্ট্রিটে লেখক প্রাবন্ধিকদের ভিড় লেগে যাবে, আর যতখানি পাওনা তার চার ভাগের একভাগ দিয়ে নতুন করে এইসব লেখকদের পোষা শুরু করবেন বাংলা প্রকাশকরা। এসব তো অতি পরিচিত কিন্তু আজ শোনাব কিছু পয়লা বৈশাখ পালনের কিছু অন্য গল্প। বেশিরভাগটাই ওপার বাংলার যদিও।
বাংলাদেশে চট্টগ্রাম লালদিঘি ময়দানে জব্বারের বলি খেলা নামে এক কুস্তির আসর বসে ১২ বৈশাখ। ঢাকায় রমনার বটমূলে ১৯৬৩ সাল থেকে ছায়ানটের নৃত্যগীতিসহ বর্ষবরণ অনুষ্ঠিত হয় মূলত ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদের স্মারক হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ প্রভাতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে রংবেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। ঈশা খাঁর সোনারগাঁয় প্রায় ১০০ বছর ধরে পয়লা বৈশাখ থেকে পাঁচ দিনব্যাপী ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম ‘বউমেলা’। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা তথা ত্রিপুরাদের বৈশু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসব সম্মিলিতভাবে বর্তমানে তিনটি জাতিসত্তা একত্রে ১লা বৈশাখে বৈসাবি উৎসব পালন করে যার অন্যতম অঙ্গ মারমাদের পানি উৎসব। বাংলাদেশের সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে পয়লা বৈশাখে যামিনী সাধকের স্মৃতিতে নৌকায় খিচুড়ি রান্নার মাধ্যমে ‘ঘোড়ামেলা’ নামে একটি বিরাট মেলা আয়োজন করে যেখানে বঙ্গাব্দের প্রথম দিন স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রেখে বর্ষবরণে মঙ্গল কামনা করে। পয়লা বৈশাখ এভাবেই আমরা পুষে রেখেছি বুকের ভিতর।
আরও পড়ুন: এলো কৃষ্ণচূড়ায় রঙ ছড়িয়ে