১৪ নম্বর গলি
রা জে শ চ ন্দ্র দে ব না থ
গল্পের ছবি: প্রীতি দেব
রিক্সা থেকে নেমেই সোজা হাঁটা দিল রাজু।ব্যাপারটা তার কাছে মোটেই সহজ নয়। বদলে যাওয়া জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যের মুখোমুখি কখনো কখনো এমন এক গলির মুখে এনে দাঁড় করায়, যা কল্পনাতীত। রাজুর মন আর বিবেককে এক অশান্ত ঢেউ তোলপাড় করে তোলে।তাকে আসতে হয় এক যৌনতা নির্ভর কারখানায়।যেখানে সমস্ত আদিম খিদে বীর্য পতনের টুপটাপ শব্দে বেঁচে থাকে হাজারো শরীরের কান্না।
১৪ নম্বর গলির মুখে একটু থমকে দাঁড়ালো রাজু। শিলচরের এই দুপুরের ভ্যাপসা ঘামে ভিতরের চিত্রটা কল্পনা করে নিল।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে ঢুকতেই নজরে পড়লো পৃথিবী দেহকামনার এক ভিন্ন রূপ।
দু-ধারে এলোমেলো দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে প্রত্যেকের তুমুল ডাকাডাকি।
ডান দিক থেকে প্রথম ডাকটা শুনতে পায় রাজু।ডাক বললে ভুল হবে।ঘন্টাখানেক যৌনকর্মের জন্য তুমুল আবেদন। সে এক মোহমুগ্ধ বেঁচে থেকে নিজেকে বেঁচে দেবার রৌদ্রতপ্ত বাজার। ওদের দিকে নজরটা যেতেই শিউরে উঠলো। জনা বিশেক মেয়ে ব্রা আর প্যান্টি পরেই দাঁড়িয়ে কাস্টমার টানবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। সবারই লক্ষ্য পুরুষ নামক জীবটাকে বিছানায় আমন্ত্রণ জানিয়ে কিছু রোজগার করা।
গলিটা সকলের কাছে পরিচিত। ভদ্রবাসীরা এই গলি থেকে দূরে থাকে।তারা গলির নাম মুখে আনতে চায় না। রাজু সময়ের কোপে আজ এই গলির অতিথি। দু-ধারে এই মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাদের চেহারায় যেন নিজের জন্ম দেওয়া জননীর মুখখানা দেখতে পায় সে।এরা কারো বোন, কারো মেয়ে,কারো ভালোবাসা। স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় আজ এরা দেহবিক্রেতা।গলিতে সকল ধর্ম- বর্ণ মিলেমিশে একাকার।
একটু এগুতেই একটি মেয়ে হাত নেড়ে বললো- ‘কিরে যাবি নাকি।চল।মাত্র ১০০ টাকা।দেখ এগুলি পছন্দ হয় কিনা।’ এই বলে নিজের ধবধবে লাল ব্রা ঢাকা স্তন দুটো একটু উপরে তুলে নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখাল।
রাজুর পা যেন চলছেনা।এই প্রথম তার অভিজ্ঞতা। সামনা সামনি এমন করে মেয়েদের সে কক্ষনো দেখেনি।আজ তার কাছে পুরো ব্যাপার টাই যেন অগ্নিপরীক্ষা। রাজু কিছু জবাব না দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই এক যুবতী তার হাত ধরে দাঁড় করালো।
-‘আর কত যাবি।আয় আয়…’
রাজুর চোখ যতই দূরে যাচ্ছে ততই যুবতীদের তোলপাড় করা শরীর।তার পা দুটি অলস হয়ে আসছে।সে ঢোক গিলে বললো – ‘ আসবো বলতে…’
-‘টাকার কথা চিন্তা করিস না। কম টাকায় ফুল বডি পাবি।’
-‘টাকা নয়। বলছিলাম কি…’
-‘তোকে কিছুই বলতে হবে না। যা বলবো, যা করবো সবই আমি।তুই কেবল তনুশ্রী শরীরের উত্তাপ নিবি…’
-‘তুমি যা ভাবছো তা নয়’
-‘কি তুমি তুমি…।তুই করে বল।বুঝলি শুধু তুই।প্রথম আসলি বুঝি পল্লীতে।’
-‘হ্যা তুমি ঠিক বলেছো’
-‘আবার তুমি।বললাম না তুই করে বলতে। ভিতরে চল’
এই বলে রাজুকে হাত ধরে সিড়ি দিয়ে নিয়ে গেল উপরে। ছোট্টখাট্টো একটি ঘরে। ইতস্তত চোখে রাজু কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারেনি। দরজা বন্ধ করে দিয়ে জানালাটাও বন্ধ করে নিল।ভেন্টিলেটরের মৃদু আলোয় রাজু পুরোপুরি অপ্রস্তুত ছিল।
-‘নে চটজলদি খুলে ফেল।দেরী করিস না’
কথাগুলি বলতে বলতে মুহুর্তেই নিজের সমস্ত কাপড় এক এক করে খুলে নিল তনুশ্রী। পুরো নগ্ন শরীর।সাদা ধবধবে।নাভির নিচে কালো তিলটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিছানার নিচ থেকে কন্ডোমের প্যাকেটটা নিয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে বললো – ‘কিরে এখনো খুললি না। যা করবি চটজলদি করতে হবে।’
এই বলে মেয়েটি নিজেই
রাজুর সার্ট প্যান্ট খুলতে গেলে সে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো-‘দিদি তুমি যা ভাবছো আমি তা করতে আসেনি…’
রাজুর মুখে দিদি ডাক শুনে প্রায় হতভম্ব হয়ে গেল মেয়েটি।কিছুটা কর্কশ শব্দে খিস্তি দিয়ে বললো – ‘হারামজাদা ইয়ার্কি হচ্ছে।রেন্ডি পাড়ায় এসে দিদি ডাকা হচ্ছে।কিছু করবি না! তো তুই কি করতে এসেছিস…’
এতক্ষণ যে মেয়েটি নরম গলায় খাতির করছিলো তার মুখে এমন বিভৎস্য গালি শুনে রাজু একটু ভীত হয়ে উঠে। মেয়েরা এমন খিস্তি দিতে পারে এটা তার ধারণাতীত ছিল। সে মাথা ন্যুয়ে ধীর গলায় বললো-
-‘মাকে চাই।মার খোঁজে এসেছি’
-‘মার খোঁজে? মাথা ঠিক আছে তো…শালা ধান্ধার টাইমে ফাজলামো হচ্ছে?’
এই বলে সজোরে রাজুর পেছনে লাথি বসালো তনুশ্রী। রাজু কুঁকড়ে উঠলো। কিছুটা ভীত স্বরে বললো -‘ধান্ধা খারাপ নয় দিদি।তুমি যত টাকা চাও দেবো। তবু মাকে খুঁজে দাও।’
-‘খুঁজে দেবো মানে? তুই এখানে কি জন্য এসেছিস? কি বলতে চাইছিস খুলে বল।’
রাজু এতক্ষণ গরমে ঘেমে একশা হয়ে গিয়েছিল।সে জামা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো-‘ মা জন্মের পর আমাকে ছেড়ে হারিয়ে যায়। কোথায় চলে যায় কিছুই জানতাম না। আমি গর্ভে থাকতেই বাবা এক অ্যাক্সিডেন্টে…! কাকাদের কাছে বড় হই।যে দিন বুঝার বয়স হল কাকাদের কাছে জানতে পারলাম বড় মামা মাকে এখানে বিক্রি করে দেয়…’
কথা গুলি বলতে বলতে চোখের কোনে জল নেমে আসে রাজুর।সে শুধু একটি কথাই বারবার বলছিল, মাকে চাই…।মাকে খুঁজে দাও প্লিজ।
তনুশ্রী যেন এবার নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল।রাজুর মুখে কথাগুলি শুনতে শুনতে তনুশ্রীর মাতৃত্বের নরম বুকটিও জেগে উঠে। সে কিছুটা ঠাণ্ডা গলায় বললো – ‘এখানে একবার কেউ আসলে কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে। এই পল্লীতে এত ঘর কোথায় খুঁজবি।তা ছাড়া বহু বছর আগের ঘটনা…’
-‘সে আমি জানিনা। তুমি পারবে নিশ্চিত। তুমি খুঁজে দাও’
-‘এই পল্লীর সমস্ত খবর রাখেন মিতা মাসি।উনি কিছু জানলে জানতে পারেন।’
-‘তবে আমাকে ওঁর কাছে নিয়ে চলো… ‘
তনুশ্রী ব্রার হুক লাগাতে লাগাতে বললো-‘যা বুঝতে পারছি তোর জীবনের গল্প আমাদের থেকেও করুণ। তবে মিতা মাসি তোর কতটা উপকারে আসে বুঝা মুস্কিল…এখানে সবাই নিজের আসল নাম ভুলে ছদ্মনামে পরিচিত হন। তোর মার নাম বললেও লাভ হবেনা।তুই জন্মের পর তোর মাকে হারিয়েছিস।এখন তুইতো দেখলেও চিনতে পারবি না। দু-যুগ আগের ঘটনা। এই পল্লীতে এক যুগেই চেহারা বদলে দেয় কাস্টমাররা।যাই হোক চল…’
এই বলে রাজুকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিচে একটি রুমে নিয়ে আসলো মেয়েটি।বিছানায় রাজুকে বসিয়ে বললো -‘এখানে বস। মিতা মাসিকে ডেকে নিয়ে আসছি।’
রাজু মাথা নেড়ে বললো – ‘ ঠিক আছে’
রাজুর বুকের ভেতর ছমছম করছে।যে করেই হোক মার খোঁজ পেতেই হবে।
কিছুক্ষণ পর সেই মেয়েটি এক বৃদ্ধাকে ধরে ধরে ঘরে আনলো।বেশ জরাজীর্ণ মহিলা।বয়সের ছাপ স্পষ্ট। বিছানায় বসে মহিলা রাজুর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।
‘বাবা তুমি কি তোমার মাকে খুঁজতে এসেছো!মার কথা এখনো মনে আছে?’ – বৃদ্ধা কাশতে কাশতে কথাগুলি বলছিল।
রাজু বললো -‘ মাসি মার কথা কেউ কি ভুলতে পারে?তুমি জানো আমার মা কি এখানে আছে…’
মাসি বললো-‘ এত বছর আগের কথা
এখানে আসার পর সবাই হারিয়ে যায়। তোর মাও হারিয়ে গেছে। ‘
-‘তুমি কি করে বলছো হারিয়ে গেছে। তুমি কি চিনতে পেরেছো?’
-‘তনুশ্রী আমাকে নিয়ে আসতে আসতে সব বলেছে। নিজের ভাই যখন বোনকে বিক্রি করে দেয়, সেখানে তার কষ্ট বহন করে চলে হাজার বছর ধরে সহস্র রমনী। তারা দেহ বিক্রি করে আর বয়ে চলে সকল যন্ত্রনা যুগের পর যুগ।বাবা তোর মা নেই।মরে গেছে কবেই। এই পল্লীতে আসলে আত্মীয়স্বজনরা কোনো খবর রাখেনা। বাবা তুই এসেছিস… যে মা তোকে গর্ভে ধারন করেছে সে সার্থক।’
রাজুর চোখ ভিজে উঠলো।মার মৃত্যুর কথা শুনে তার আর কথা বলার অবস্থায় ছিল না।গলা আটকে আসলো।কিছুক্ষণ সবাই চুপ।রাজু নিশ্চুপ মনে ধীর পায়ে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো…
মিতা মাসি রাজুর যাবার পথে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মনে মনে বললো-‘ভালো থাকিস বাবা। ক্ষমা করে দিস।মুখ ফুটিয়ে বলতে পারলাম না, আমিই তোর হতভাগী মা। ‘
আরও পড়ুন: রবিবারের সান্ধ্য কবিতার আসর-৪