রাজস্থান ভ্রমণ-১ : কুলধারা
দেবশ্রী চক্রবর্তী
রাজস্থান ভ্রমণ করার ইচ্ছে বারবার জাগে মনে। প্রাচীন জনপদ কিংবা অট্টালিকা আমাকে আজীবন গভীর ভাবে আকর্ষণ করেছে। তাই সময় পেলে প্রকৃতি এবং ইতিহাসের টানে ছুটে যাই দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। গভীর অরণ্য কিংবা মরু প্রদেশের সোনালী বালু-রাশির মাঝে লুকিয়ে থাকে এমন কিছু রহস্য-রোমাঞ্চ, যা আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এসব ঐতিহাসিক স্থানে জড়িয়ে থাকে কত গল্প-কল্পকাহিনী। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হতে থাকে সত্য মিথ্যার এক আলো-আঁধারী ইতিহাস। এমন-ই এক নগরীর গল্প শোনাবো আজ।
গত বছর দুর্গা পূজোর নবমীর দিন আমরা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে ভিস্তারার বিমানে করে উড়ে গেছিলাম রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরে। পাঁচ বছর আগে রাজস্থান গেলেও আমাদের মরু অঞ্চলগুলো দেখার সুযোগ হয়নি। তাই এইবার ঠিক করেছিলাম মরু অঞ্চলে লুকিয়ে থাকা বেশ কিছু রহস্যময় জায়গায় আমরা ভ্রমণ করবো। সেই মতন বেশ কিছু দিন গবেষণার পরে আমরা যে জায়গাগুলো আমাদের তালিকায় তুলে আনি, তার মধ্যে সর্বশেষ জায়গাটি দিয়ে আজকের লেখা শুরু করব। আমার রাজস্থান ভ্রমণের প্রতিটি পর্বে আমি তুলে ধরবো এমন কিছু জায়গায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যা হয় তো আমার পাঠকদের রোমাঞ্চিত করে তুলবে।
আমাদের রাজস্থান ভ্রমণের সব শেষ গন্তব্য ছিল জয়সলমীর। রাজস্থানের জয়সলমীর ভারতের প্রসিদ্ধ একটি শহর। তবে আমাদের এই কাহিনী জয়সলমীরকে কেন্দ্র করে নয়। জয়সলমীর থেকে খুব বেশি একটা দূরে নয়, ১৭-১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি শহর, নাম কুলধারা। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এই নগরটি কীভাবে এক রাতের মধ্যে অভিশপ্ত হয়ে পড়লো আজ তারই কাহিনী বলব।
আমরা জয়সলমীরে উঠেছিল হেরিটেজ হাউসে। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা ড্রাইভার মহেন্দ্র সিং-এর সাথে বেরিয়ে পড়ি কুলধারার পথে। চারিদিকে হলুদ পাথরের প্রাসাদ আর সোনার কণার মতন ধূলা উড়িয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলে হাইওয়ের দিকে। হলুদের মাঝে মরু অঞ্চলের সবুজ গাছপালা সত্যি আমাদের মন কেড়ে নিয়েছিল। হাইওয়েতে উঠতেই চোখে পড়ে রাস্তার দুই ধারে মরুভূমির মাঝে উইন্ড মিল, বাতাসে পাখা ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। আরো কিছু দূর যেতেই চোখে পড়ে মরুভূমির শুষ্ক মাটিতে চলছে চাষাবাদের কাজ। মহেন্দ্রজির কাছ থেকে জানতে পারলাম জয়সলমীরে সরস্বতী নদীর গতিপথ আবিষ্কারের পরে শুষ্ক মরু খাদে খননকার্য চালিয়ে তুলে আনা হচ্ছে জলস্রোত। সেই স্রোতকে কাজে লাগিয়ে কাজ চলছে সবুজায়নের। বর্ডার রোড বলে রাস্তা খুব ভালো ১৯ কিলোমিটার যেতে আমাদের ১৫ মিনিটও সময় লাগলো না। আমরা দেখলাম একটা বিশাল রাজস্থানি ভাস্কর্য খচিত প্রবেশ দ্বার, যার ওপর লেখা আছে ‘কুলধারা’। বাইরে টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে আমরা প্রবেশ করি ভেতরে। গাড়ির জন্য আলাদা ভাড়া দিতে হয়েছিল। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে দুটি বাচ্চা মেয়ে ছুটে আসে আমার কাছে। নাম জানতেই বলে শুঁখি আর রুখি। ওরা আমাকে বলে, “আন্টি আপ কাহানী শুনোগি?” আমি বললাম, “চল, শুনা”। ওরা আমাকে অত্যাচারী প্রধানমন্ত্রী সলিম সিং-এর কা্হিনী শোনাতে নিয়ে চলে কেশবজীর মন্দিরের দিকে। শুঁখি আর রুখি আমাকে বলে, “কর আদায়ের জন্য হেন দুর্নীতি ছিল না, যার আশ্রয় তিনি নেননি। এই সেলিম সিংয়ের একদিন নজর পড়ল কুলধারার গ্রাম-প্রধানের সুন্দরী কন্যার দিকে। সে ওই মেয়েকে জোর করে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু ব্রাহ্মণদের প্রতিবাদের মুখে তা সম্ভব হয় না। সেলিম সিং ওই মেয়েটির জন্য খুবই বেপরোয়া হয়ে উঠে। নিজে গ্রামে এসে যায়, ওই মেয়েটিকে তার চাই-ই চাই! নইলে, অস্বাভাবিক করের বোঝা মাথায় নিয়ে বাঁচতে হবে কুলধারার ৮৪টি গ্রামকে।”
সেই রাতেই ঘটে যায় এক অদ্ভুত ঘটনা। রাতারাতি ৮৪টি গ্রামের লোক যেন মিলিয়ে যায় বাতাসে! কেউ বলেন, গ্রামবাসীরা দেওয়ানের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এক বস্ত্রে। আবার কারো মতে, কুলধারার অধিবাসীরা পরবর্তী সময়ে পশ্চিম রাজস্থানের যোধপুর শহরের কাছাকাছি কোনো একটি স্থানে বসতি গেড়েছিল। কিন্তু এই বক্তব্যের মধ্যে তেমন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। ৮৪টি গ্রামের লোক না-হয় রাতের আঁধারে গ্রাম ছাড়তেই পারে! কিন্তু এত বড় দল কোথাও যদি চলে বা পালিয়ে যায়, তবে কোথাও না কোথাও তো পথের মধ্যে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে। অথচ কেউ-ই তাদের দেখলো না তা কী করে সম্ভব! আর তারা যদি অন্যত্র গিয়ে বসতি গড়তো তাহলে তাদের বর্তমান প্রজন্মও থাকার কথা। কিন্তু পুরো ভারতে কুলধারা গ্রামের পালিওয়াল সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণদের কোথাও দেখা পাওয়া যায়নি। সেরকম তথ্যও কারো কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তাহলে কি অলৌকিক কোনো বিদ্যার আশ্রয় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা? আত্মহত্যা করলেও তো দেহ পড়ে থাকত! কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। দেওয়ান এসে দেখেছিলেন, গ্রামের পর গ্রাম ফাঁকা পড়ে আছে। সব কিছুই রয়েছে যথাস্থানে। শুধু মানুষ নেই!
সেলিম সিং এর পর নতুন করে গ্রাম বসানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউ সেই গ্রামে রাত কাটাতে পারত না। তাদের মৃত্যু হত। মৃত্যুর কারণও জানা যেত না। এরপর থেকে নানা কাহিনী প্রচার হতে থাকে। তবে অধিকাংশ লোকেই মনে করে কুলধারার অধিবাসীদের অভিশাপের কারণেই আর কেউ এই এলাকায় বসতি স্থাপন করতে পারেনি। মিলিয়ে যাওয়ার আগে তারা নাকি অভিশাপ ছড়িয়ে দিয়েছিল নগরীর বাতাসে, কেউ এখানে বাস করতে পারবে না। যেমনটা তারাও পারেনি! সেই থেকে কুলধারা এক পরিত্যক্ত নগরী হয়ে পড়ে রয়েছে আজ।
সেদিন এই দুই মরু-বালিকার হাত ধরে ঘুরেছিলাম সম্পূর্ণ গ্রামটি। অবাক হয়ে দেখেছিলাম এত বছর পরেও কিভাবে অবিকৃত থেকে গেছে বাড়িগুলো। কিছু কিছু বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম, তার ইট, কাঠ পাথরে হাত রাখতেই শরীর যেন কেঁপে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে কানের কাছে। তখন মনে হয়েছে, সেই ঘটনার পর কত কত বছর কেটে গেল, তারপরও নতুন করে জনবসতি গড়ে উঠেনি কুলধারায়! জয়সলমীরের কুলধারায় এখন অবধি কেউ পা-রাখতে সাহস করেন না। অন্তত রাতের বেলায় তো নয়ই! কুলধারায় যারা রাত কাটিয়েছেন, কোনো না কোনো বিপদের মুখে পড়েছেন। কুলধারায় রাত কাটিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে মৃত্যুর দিকে, এমন উদাহরণও কম নেই!
[ আরও পড়ুন: বিশ্ব ভ্রমণের কথা : এই দেশে ভারতের ১ টাকা সমান ৩৫০ টাকা]
সোনালি বালির মাঝে মরূদ্যানের মতোই মাথা তুলে একটা সময়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে ছিল কুলধারা। ৮৪টি ছোট ছোট সম্প্রদায় ভিত্তিক গ্রাম মিলিয়েই গড়ে উঠেছিল এই নগরী। ১২৯১ সালের দিকে মূলত পালিওয়াল ব্রাহ্মণরা এই গ্রামের পত্তন করেন। সেই সময় প্রায় পনেরো শো মানুষের বেশ সমৃদ্ধ এক জনপদ ছিল কুলধারা। রাজস্থানের চারপাশ মরু অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও কুলধারায় কিন্তু সেই সমস্যা ছিল না। আবহাওয়া ও প্রকৃতি একটু ব্যতিক্রমই ছিল বলা যায়। এই অঞ্চলে শস্যের কোনো কমতি ছিল না।
পালিওয়াল ব্রাহ্মণরা মূলত কৃষি কাজে দক্ষ ছিল। ফলে এলাকাটি কৃষি এবং ব্যবসার জন্য বেশ বিখ্যাত ছিল সেসময়। কী ছিল না কুলধারায়! প্রাচীন মন্দির থেকে শুরু করে, নিখুঁত নকশায় বানানো বিভিন্ন বাড়ি এখনও অক্ষত দেখা যায়।কিন্তু হঠাৎ এক রাতেই এই নগরী জন-মানবহীন হয়ে পড়ল। রাজস্থানের মতো রুক্ষ অঞ্চলে যেখানে বসবাসের উপযোগী জায়গা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার, সেখানে পানীয় জলের অভাব নেই, প্রকৃতিও তেমন রুক্ষ নয় এমন নগরী মানুষের বসবাসের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো কেন, তা খুবই অবাক করা ব্যাপার। ১৮২৫ সালের দিকে মাত্র এক রাতের মধ্যেই চুরাশিটি গ্রামের অধিবাসীরা স্রেফ গায়েব হয়ে যায়। টানা সাত শতক ধরে এই গ্রামে বসবাস করার পর কেন ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা হঠাৎ করেই এই নগরী ছেড়ে চলে গিয়েছিল তা আজও সকলের কাছে অজানা।
অক্টোবরের গরমে সারা গ্রামটি ঘুরতে সত্যি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। সরকারি একটি শরবত-এর গাড়িতে খাবার জল আর শরবত বিক্রি হচ্ছে দেখে আমরা স্বামী-স্ত্রী, আমাদের মেয়ে ফ্রুটি রুখি আর শুঁখিকে সঙ্গে করে শরবত খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি। ওরা আমাদের সিঁড়ি দিয়ে পাতালের দিকে নিয়ে চলে। পুরনো দিনের ইটের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে সত্যি একটু ভয় করছিল, কিন্তু ইটের গাঁথুনি এখনো বেশ পোক্ত। নিচে নামার পরে দেখি সরু পথ অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। ওরা আমাদের বলে, কথিত আছে এই পথ সারা ভারত তথা পাকিস্তানের সাথেও যুক্ত। কিছু মানুষ মনে করেন এই পথ দিয়েই ব্রাহ্মনরা পালিয়ে ছিলেন। কিন্তু এত সরু পথ দিয়ে কিভাবে কোনো মানুষ যেতে পারে বুঝতে পারছিলাম না। বেশ অন্ধকার রাস্তা, চামচিকেদের দৌরাত্বে বেশি দূর যেতে পারিনি। তাছাড়া আমার স্বামীও বলল সাপ থাকবেই এই সব জায়গায়, আর মরুভূমির সাপ খুব বিষাক্ত, তাই না যাওয়াই ভালো। সিঁড়ি দিয়ে যখন ওপরে উঠে আসছি, বেশ কিছু স্থানীয় মানুষ আমাদের বললেন, আপনারা ওখানে গিয়ে ঠিক করেননি।
স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে জেনেছিলাম এই নগরটি নিয়ে কিছু গবেষক নানারকম গবেষণাও চালিয়েছিলেন। সেসব গবেষণায় এমন কিছু বিষয় উঠে আসে যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ২০১৩ সালে দিল্লির প্যারানর্ম্যাল সোসাইটির বেশ কিছু সদস্য রাত কাটাতে গিয়েছিল কুলধারায়। অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে তাদের চারপাশের আবহাওয়া। এই কনকনে ঠাণ্ডা, তো এই অসহ্য গরম! আর তাপমাত্রার ওই দুই অবস্থাতেই স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়।
কয়েকজন সদস্যকে ধাক্কা দেয় কেউ! পিছনে ফিরে দেখা যায় ধারে-কাছে কেউ নেই! রাত বাড়লে শোনা গিয়েছিল কান্নার আওয়াজ। সকালবেলায় উঠে তারা দেখতে পান, গাড়ির কাঁচে কোলের শিশুর হাতের ছাপ! মোট ৫০০টি স্থানে পরীক্ষা চালিয়ে এরকম বেশ কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন গবেষকরা। তাহলে কি এখনও বছর তিনশো আগের ওই গ্রামবাসীরা অদৃশ্য হয়ে, অশরীরী রূপে থেকে গিয়েছেন গ্রামেই?
কালের নিয়মে কিছু বাড়ি তো ভেঙে চুরে গেলেও বেশ কিছু বাড়ি এখনও অটুট আছে। অটুট আছে মন্দিরও। কালের এতটুকুও আঁচড় পড়েনি গ্রামের মাঝখানের ছত্রীতে। একটু অবাক করা ব্যাপার নয় কি? সময়ের সাথে সাথে যেখানে সব বাড়ি পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে, সেখানে এই তিনটি রক্ষা পায় কীভাবে? কীভাবেই বা রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে অক্ষুণ্ণ থাকে বাড়ির দেওয়ালের অলঙ্করণ? এখনো অবিকল একই রকম অবস্থায় আছে নগরটি। কুলধারার আশেপাশের অঞ্চলগুলো অনেক উন্নত হয়ে গেলেও কুলধারা যেন সেই সময়টিতেই থমকে আছে। বর্তমানে ভারত সরকার একে হেরিটেজ নগরী হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে মরুভূমির মাঝে। সূর্যাস্তের রক্তিম আভা এসে পড়ে গ্রামের বুকে। তখন আমরা ছাড়া আর কেউ ছিলাম না সেই গ্রামে। এক অদ্ভুত আলো আঁধারির মাঝে আমার চোখে ধরা পড়ছিল কিছু প্রাচীন লুপ্তপ্রায় বর্ণমালা, যার মাঝে লুকিয়ে ছিল রহস্য সমাধানের রাস্তা। হাতে সময় খুব কম, ফিরে আসার তাড়া। আমার দুই মরু কন্যাকে আমার ভালোবাসা আর আশীর্বাদ জানিয়ে বিদায় জানাই, আমার স্বামী কিছু অর্থ তুলে দেয় ওদের হাতে। এভাবে দুটি মেয়েকে নির্জন স্থানে রেখে যাওয়া ঠিক না। তাই আমাদের গাড়িতে ওদের তুলে নিই। কথা বলে জানতে পারি, দু-কিলোমিটার দূরে যে বাঞ্জারাদের গ্রাম আছে, সেখানে ওরা থাকে। উলটো পথে সেই গ্রামে গিয়ে ওদের রেখে আবার রওনা দিই জয়সলমীরের উদ্দেশ্যে। ফেরার পথে আবার কূলধারা পড়ে। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে চেয়ে দেখি সেই দিকে। মন বলে, কেমন হয় যদি একরাত কাটিয়ে যাই?
দেখে আসবেন নাকি, সেই ভৌতিক অভিশপ্ত নগরী কুলধারা?
কলকাতা থেকে জয়সালমীর যাবার জন্য প্রতি সোমবার একটি ট্রেন হাওড়া স্টেশান থেকে সকাল ৮টা ১৫ তে ছাড়ে, যে ট্রেনটি পরেরদিন রাত ১২টায় জয়সালমীর পৌঁছায়। ট্রেনটি প্রায় ৪০ ঘন্টা সময় নেয়। এ ছাড়া দিল্লি, জয়পুর এবং যোধপুর থেকে প্রতিদিন বহু ট্রেন জয়সালমীর যায়। যারা বিমানে যেতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, কলকাতা থেকে সোজাসুজি কোনো বিমান নেই, তবে দিল্লি এবং জয়পুর থেকে বহু বিমান প্রতিদিন এই সোনার শহরে যাতায়াত করে। বিমান ভাড়া প্রায় ২৫০০ থেকে ৪৫০০ টাকার মধ্যে। কিছু মাস আগে বিমান টিকিট কেটে রাখলে খরচা কম পড়ে।
জয়সলমীর-এ সব সরকম মানুষের সাধ্যের মধ্যে বহু হোটেল আছে। ২০০ টাকা থেকে ৪০,০০০ টাকার হোটেল আছে। পকেট বুঝে অনলাইন সাইট থেকে ঘর বুক করে নিতে পারেন। অনেকে একটু অ্যাডভেঞ্চারের জন্য থর মরুভূমিতে তাঁবুতে থাকেন। আমরা মেক মাই ট্রিপ থেকে হোটেল হেরিটেজ হাউসে ঘর ভাড়া করেছিলাম। আমাদের প্রতিদিন ঘর ভাড়া পড়েছিল ৭০০০ টাকা। খাওয়া খরচ আলাদা। এই হোটেলটি একদম রাজস্থানি হাভেলির মতন, হলুদ পাথরে তৈরি প্রাসাদের প্রতিটি কোনায় রাজস্থানি শিল্পের ছোঁয়া আমরা পেয়েছি। মাছ পাওয়া যায় না, আমরা নিরামিষ খাবার বেশি খেয়েছি, তবে চিকেন পাওয়া যায়। দামটা একটু বেশি। তবে দু-তিন দিনের তো ব্যাপার। স্থানীয় রাজস্থানি খাবার খেলে মন্দ লাগবে না।
স্থানীয় জায়গাগুলো দেখার জন্য হোটেল থেকে অল্প দামে প্রাইভেট গাড়ি পেয়ে যাবেন। তবে শেয়ারে বাস, ট্রাভেলার কিংবা অন্য গাড়িও পাওয়া যায়।
জয়সালমীরে সব থেকে বেশি যে জিনিস আমাকে আকর্ষণ করেছে, তা হচ্ছে হিন্দু মুসলিম ঐক্য। ভারতবর্ষের শেষ প্রান্তের এই শহরের মানুষের দেশভক্তি এবং একতা একবার নিজের চোখে দেখেই আসুন। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর জয়শলমীরে ভয়ঙ্কর গরম পড়ে। সকালবেলা ধূলিঝড় হয়। তাই অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি যে কোনো সময় একবার ঘুরে আসুন সোনার কেল্লার এই রহস্যময় শহরটিতে।
আরও পড়ুন: সুন্দর ও শান্তির দেশ । যেখানে নাই কোনো সেনা, নাই কোনো নেভি !