Breaking News
Home / রবিবারের আড্ডা / গল্প / রবিবারের ছোটগল্প অসুখ লিখেছেন দুঃখানন্দ মণ্ডল

রবিবারের ছোটগল্প অসুখ লিখেছেন দুঃখানন্দ মণ্ডল

রবিবারের ছোটগল্প

অসুখ

দুঃ খা ন ন্দ ম ণ্ড ল

অসুখ

Illustration: Preety Deb


এক.
একটি ভোরের আলো ছুঁয়ে আর একটি সকাল আসে, আসে নতুন কাজের দিন, আসে ব্যস্ত জীবনের গতি।
বসন্তদা। মানুষটির কোনো পদবী নেই।আছে হয়তো কিন্তু কেউ জানার আগ্রহ দেখায়নি কখনো। মোড় বা পাড়ার ঠেকে বসন্তদা একটু দাদার মতোই। কিন্তু কাজও করে বটে।
বেশ কয়েকদিন চোখে পড়ে না বসন্তদাকে।
চলমান পৃথিবী ব্যস্ত। তাই পাড়ার মানুষজনের সময়ও হয়ে ওঠে না বসন্তকুঠির ঘুরে যাওয়ার।
একটি সরু লাল মাটির রাস্তা তার বাড়ির উঠানে শেষ হয়েছে।অর্থাৎ সে শেষের লাইনে।
ঠকরা লক্ষ করেছে। কয়েকদিন ওই বাড়ির নোংরা ফেলছে না তার “আমাকে ব্যবহার করুন গাড়িতে”!
ঠকরা পৌরসভার ময়লাদার। সে গর্বের সাথে বলে দাদা ব্যস্ত আছি তাড়াতাড়ি করুন।
: দাদা ও দাদা। আজ তিন দিন হলো তোমার বাড়ির ময়লা ফেলছো না যে? ও দাদা… দাদা…।
কোনো সাড়া না পেয়ে বাহিরের গেটটা খুলে ঢুকলো। দরজায় ধাক্কা দিতেই, ভিতর থেকে বলল, কে?
: আমি ঠকরা। তোমাকে ডাকছি তুমি সাড়া দিচ্ছো না, তাই ঢুকে পড়লাম।
: আয়!শলীলটা ভাল নেই।তাই শুয়ে আছি।
: কি হচ্চে?
: না তেমন কিছু না।
: দেখি।
ঠকরা কপালে হাত দিয়ে দেখল। ঠকরার নোংরা হাত তার কপালে লাগা মাত্রই বসন্তদা অনুভব করলো এক শক্তি, যে শক্তি মাটি আর মাকে আঁকড়ে রাখে।
: দাদা তোমার তো জ্বর।
: ঠকরা তোর মাটি মাখা হাতটা কিছুক্ষণ আমার মাথায় রাখনা! বড্ড আরাম লাগছে।
: আরে বাবা আমার সময় কোথায়! তাড়াতাড়ি ময়লা ফেলে তোমার অসুধ আনতে হবে।আমি এখন আসি।
: তুই একটু বস না, বস।
: তুমি বুঝতে পারছো না। তোমাকে অসুধ দিতে হবে!

বসন্তদার পায়ের কাছে দুটো ক্লান্ত বিড়াল শুয়ে আছে। তারাও যেন অসুস্থ!
ঠকরার ভ্যানের শব্দ ক্রমশ: ক্ষীণ হতে লাগল।

দুই.
৯/৬ একটি ছোট রুম। বসন্তদা বেশ কয়েকদিন সময় কাটিয়ে নিচ্ছে। পূর্ব দিকে ছোট দেওয়াল আলমারি। তাতে কিছু হাবিজাবি বইপত্র। তাতে আবার একহাঁটু ধূলো জমা হয়ে আছে। পশ্চিমে একটি কাঁচের জানালা, দক্ষিনে গোটা ঘর নিয়ে একটি কাঠের জানালা। যেখানে চব্বিশ ঘন্টা বাতাস আর উত্তরে ছোট একটি দরজা।
সকালে বসন্তদা সূর্য দেখে না, দেখে বিকেলের সূর্য। গোধূলি রং-রঙিন হয়ে দূরের নারকেল গাছের পাতা ভেদ করে বসন্তদার পশ্চিমের কাঁচের দেওয়ালে এসে পড়ে আর ভেদ করা গোধূলি আভা মেখে নেয় তার শরীর।
হঠাৎ তার চোখে পড়ল; একটি অজানা পাখি। কাঁচের মধ্যে ঠক্কর মারছে। বসন্তদার বোধগম্য হলো না। কারণ কি? লক্ষ করল পাখিটির প্রতিচ্ছবি। আসলে ও-মনে করছে ঐ প্রান্তে আর একটি ওর মতই পাখি আছে। ও-প্রতিনিয়ত টক্কর দিয়ে চলেছে।ও-ওকে ছুঁতে চাইছে। ওকে স্পর্শ করতে চাইছে। ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকা বসন্তদার বিড়ালটা শব্দে জেগে গেছে। ও তাক করে আছে, পাখিটিকে ধরবে বলে। কিন্তু বসন্তদা অন্য কিছু দেখছে। খু্ঁজে বেড়াচ্ছে কারণ! সূর্যের আলো একেবারে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। পূব দিকে অন্ধকার নেমে আসছে। তখন পাখিটি চেষ্টা করছে অপর প্রান্তের পাখিটিকে ছুঁতে…
: বসন্তদা এই নাও তোমার অসুদ।একটু দেরি হয়ে গেল।
: ঠকরা, তুই আবার এ-সব করতে গেলি কেন?
: কি হয়েছে? বাড়িতে কেউ নেই তাই দাদার জন্য এটুকু করলাম। আচ্ছা কিসের শব্দ আসছে বলো তো!
: আরে দেখ না একটা পাখি দুপুর থেকে পশ্চিমের জানালায় ঠক্কর দিচ্ছে।
: দাঁড়াও আমি তাড়িয়ে দিচ্ছি। যা যা…
: আরে না না। থাক।
বলতে বলতে তাড়িয়ে দিল পাখিটাকে।
: ও! আচ্ছা।এই রকম-ই একটা পাখি ঐ দূরে মরে পড়ে আছে। মনে হচ্ছে ওকে খুঁজছে!
বসন্তদার বুকটা ধড়াস করে উঠল। পশ্চিম আকাশে অন্ধকার নেমেছে। ঠকরা ফিরে গেছে নিজের বাড়িতে। কিন্তু সেই অপরিচিত পাখিটি ফিরে এসেছে পশ্চিমের কাঁচের জানালায়। ঘরে রাতের আলোতে আবছা নিজের মুখটি দেখতে পাচ্ছে পাখিটি। রাত্রি বাড়ছে আর পাখিটির ঠোঁটের শব্দ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে…

৩.
খোলা জানালা। বসন্তদা খুব একা। কখনও ভালো থাকে কখনও বা খুব অসুস্থ। একেবারে ঘর বন্দী। জানালা দিয়ে যতদুর দৃষ্টি আসে ততদুর পানে তাকিয়ে থাকে।
কালা বুড়ি অনেক দিন পর তার ছাগল নিয়ে চরাতে এসেছে। বুড়ি তার ছাগলদের নাম ধরেই ডাকে। কারো নাম মণি, কারো নাম লালি, কারো নাম আবার তুলসী।
কি আশ্চর্য বিষয়। বুড়ি যার নাম ধরেই ডাক দেয়, সেই ছুটে আসে আর জিভ দিয়ে বুড়ির গা চাটে। কি এক ভালোবাসা, কি এক সম্পর্ক অবলা পশুর সাথে। যেন সন্তান আর তার মা!
বসন্তদা পশ্চিমের সূর্য আলো আসা জানালাটা দিয়ে কালা বুড়ি আর তার ছাগলদের দেখে।
বসন্তদা এই দৃশ্য আর দুর থেকে দেখতে পারলো না। জীর্ণ শরীর নিয়ে বাহিরের দারজার কাছে এসে বুড়িকে ডাক দিল, ও বুড়ি মা, বুড়ি মা!
শুনতে আর পেল না। অনেক ডাকার পরে বসন্তদাকে দেখে বুড়ি কাছে এলো।
: হেরে বসন্ত এতো দিন কুথায় ছিলি? তোকে দেখতে পাইনি কত দিন।
বসা গলায় বুঝাতে চেষ্টা করল সে অসুস্থ।কিন্তু শুনতে পেল না বুড়ি মা।
: আরে তুই নেই ভেবে আমি তো বাগানে এদেরকে নিয়ে আসিনি। তুই অনেক রোগা হয়ে গেছিস। এই লালি এদিকে আয়। ওখানে অনেক বন।
: ও-কালির মা, কালির মা। এদিকে এসো।তোমার ছাগলের জালায় আমি কি একটু চাষও করতে পারবো না! চিৎকার করে পাশের জমির মালিক বলতে লাগল।
: তোর কি ফসল খেয়েছে আমার বাচ্চারা! আলের ধারে একটু না হয় ঘাস খায়, তাতে তোর এমন কি ফাটছে?
: আমার যাই ফাটুক। তোমার বাচ্চাদের বেঁধে রাখো, না হলে আমি ওদের এফোড় ওফোড় করে দিবো। এই বলে রাখলাম।
: আচ্ছা আচ্ছা। তুই করে দেখা। শালা আমার এ কুলে কেউ নেই, আমি এই বাচ্চাগুলা নিয়ে বেঁচে আছি। তাও তোদের ব্যথা লাগছে!
বসন্তদার মনটা দোলা দিল। পাশের জমির মালিক বসন্তদার কাছে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে। বুড়ি চিৎকার করতে করতে ছাগলগুলো নিয়ে যেতে যেতে বলছে,
তুই কি বুঝবি সন্তান হারানোর ব্যথা…!
পনেরো বছর আগে স্বামী আর তিন বছর আগে তার ছেলে কালি একূল ছেড়ে চলে গেছে।
পাশের জমির মালিকের মুখের বিড়ির সুতোতে আগুন এসে পৌঁচ্ছে।হাত থেকে বিড়িটা পায়ের তলায় ফেলে মজে যাওয়া আগুনটা নিভিয়ে বিড় বিড় করে বলল, ছেলের অজুহাত দিয়ে ছাগল চাষ! আর তারা নাকি তার বাচ্চা! আমি যেন ঘাসে মুখ দিয়ে চলি। এই বলে হন হন করে জমিয়ে দিকে চলে গেল।
বসন্তদা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডুবে যাওয়া সূর্যের দিকে…

আরও পড়ুন: রবিবারের ছোটগল্প প্রতিপক্ষ লিখেছেন পূজা মৈত্র

Check Also

রাজস্থানের ভৌতিক গ্রাম

রাজস্থানের রহস্যময় কিরারু গ্রাম

দেবশ্রী চক্রবর্তী: ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত একখন্ড মরুপ্রান্তরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে রহস্য এবং রোমাঞ্চ। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *