ধারাবাহিক উপন্যাস
খাতা
দেবশ্রী চক্রবর্তী
Illustration: Preety Deb
রাত পৌনে বারোটা নাগাদ তিতির চার্চের সামনে পৌঁছল। সারিকা দির সময় জ্ঞান খুব বেশি, সে ঠিক সাড়ে এগারোটার সময়ই এসে পৌঁছেছিল। গাড়ি থেকে নামার সময় তিতির সমুদ্রের গর্জন শুনতে পায়। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের তীব্র গর্জন শুনে মন বেশ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। চার্চের ডান দিকে একটা বিশাল গাছ। কি গাছ অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না, গাছটা কি গাছ তা জানার কোনো ইচ্ছা এই মূহুর্তে তার নেই। চার্চের বাইরের দেওয়ালের ছোট ছোট কাঁচের জানালা দিয়ে যে হাল্কা হলুদ আলো আসছে তা এসে পড়ছে সামনের চত্ত্বরটায়। মনে হচ্ছে যেন টাইম ট্রাভেল করে তারা মধ্যযুগের ইউরোপের কোনো এক বন্দর শহরে পৌঁছে গেছে। তিতিরের মনে হল গাছের নিচে কেউ একজন দাঁড়িয়ে তাকে হাত নাড়ছে। গাছের প্রতি আকর্ষণ না থাকলেও গাছের নিচের ব্যক্তির প্রতি সে তীব্র আকর্ষণ অনুভব করলো। তিতির কিছু না বুঝেই হাত নাড়িয়ে এগিয়ে চলল গাছের দিকে। সমুদ্রের হাওয়ায় তার চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সে দু-হাত দিয়ে চুলগুলো টেনে একটা খোপা করে নিলো। এসব জায়গায় চুল খুলে না রাখেই ভালো, ঠাকুমার মুখে সে শুনেছে যুবতী মেয়েরা রাতেরবেলা চুল খুলে বেরালে ভূতে ধরে। তিতিরের মনে হচ্ছে, আজকের রাতটা তার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা রাত। তাই ভূতে ধরার আগে তার গাছের নিচে পৌছনোটা খুব জরুরি। তিতির যা ভেবেছিল, ঠিক তা-ই। রানা গাছের নিচে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
চার্চের হাল্কা হলুদ আলো রানার মুখে এসে পড়ছে, সেই আলোয় রানার চোখ দুটো খুব আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে। তিতির তাকিয়ে আছে সেই চোখের দিকে। রানা তিতিরের দৃষ্টি বোঝার চেষ্টা করছে। সাদা সুতির গাউনে তিতিরকে খুব মোহময়ী দেখাচ্ছে। কপালের পাশ দিয়ে হাল্কা চুলগুলো উড়ছে, যা রানাকে চুম্বকের মতন আকর্ষণ করছে ওর দিকে। কিন্তু এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখা হচ্ছে দু-জনের। এখনই নিজের দূর্বলতার প্রকাশ করা ঠিক হবে না। রানা জানে যে কোনো সম্পর্কে যার মানসিক জোর যত বেশি সে সব সময় দূর্বল জনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তার মনে হল, এই মেয়েটি এত রাতে তার হাতের ইশারায় যখন ছুটে এসেছে, এ আসা শুধু শুধু হতে পারে না, মেয়েটির তীব্র কোনো মানসিক চাহিদা হয় তো আছে। তাই তার এখনই দূর্বল হওয়া বোকামি হবে।
তিতির রানার চোখের দিকে তাকিয়ে যেন অবশ হয়ে গেছে, কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে এই চোখ দুটি ঠিক যেন তার স্বপ্নে দেখা পুরনো বাড়িটার ঘুলঘুলি। যা দিয়ে সে নদী, নৌকা আর বটগাছকে দেখতে পাচ্ছে। অনেকক্ষণ এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না, ছেলেটা হয় তো তাকে বেহায়া, অসভ্য মেয়ে ভাবছে। কিন্তু তিতিরের এরকম এর আগে কোনো দিন হয়নি। সে নিজেকে কন্ট্রোল করে মাথা নিচু করে বলল, আপনি কিছু মনে করেননি তো?
রানা বলল, কেন, মনে করার কি আছে?
আপনার আমাকে দেখতে ভালো লাগছিল, তাই আপনি দেখছিলেন। এতে আর দোষ কি। তাছাড়া আজকাল আমার দিকে সেভাবে কেউ তাকিয়ে দ্যাখে না। আপনি দেখছিলেন, আমি খুশি হয়েছি।
তিতির এবার ধিরে ধিরে রানার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে আমার কিছু কথা বলা খুব দরকার। যদি কিছু মনে না করেন…
রানা বলল, এসব কথা এরকম খোলামেলা পরিবেশে বলা হয় না, অনেক সাইকোলজিক্যাল কথা আছে যা সুস্থ্য মানুষজন শুনে ফেললে আপনাকে কিংবা আমাকে পাগল ভাবতে পারে। তাই চারদেওয়ালের মধ্যে হলে ভালো হয়।
তিতির বলল, কাদম্বরী আজ অতীত, কিন্তু আমি বর্তমান। আমার মধ্যে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে যার সমাধান এখন না হলে আমিও হয়তো…
কথাটা শেষ করার আগে রানা বলল, এসব প্ল্যানচেটে আমার কোনো বিশ্বাস নেই। মানসিক বিকারগ্রস্থরা এসব করে। এই সব পাগলদের মধ্যে যে মানসিক ভাবে সব থেকে বিকারগ্রস্ত হয়, সে মিডিয়াম হিসাবে কাজ করে আর ভুলভাল কল্পনা করে, তারপর তার অনুভূতি দূর্বলদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।
তিতির রানার মুখে এসব কথা শুনে অবাক হয়ে গেছিলো। সে বলল, আপনি তাহলে এখানে এসেছেন যে?
রানা কিছুক্ষণ তিতিরের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল, সে এক কারণ আছে, পরে বলবো। এখন চলো, চার্চের পেছন দিকে ফাদারের ঘর আছে। এখন ওখানে কেউ থাকে না। ঘরটা-ই কেয়ার টেকার থাকে। আমি আজ সিদ্ধার্থদার সাথে বিকেলে চার্চে এসেছিলাম। তখন কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলার সময় ওর ঘরটা আমার খুব পছন্দ হয়। আমি ওকে কিছু টাকা দিয়ে আজ রাতের জন্য ঘরটা নিজের জন্য নিয়ে নিয়েছি।
তিতির বলল, তোমার মতলব আমার ভালো ঠেকছে না। তুমি ওখানে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছ কেন? এখানে তো কেউ নেই, গাছের তলায় বসেই আমরা কথা বলতে পারি।
রানা এবার একটু শক্ত হলে বলল, এখানে সমুদ্রের আওয়াজ আসছে, সেই সাথে ঝড় বাতাস। এসবের মধ্যে কাউন্সিলিং হয়না। তাছাড়া ফাদারের ঘরের একটা বিশেষত্ব আছে। যা আমি তোমাকে এখনো বলিনি।
তিতির আর কোনো কথা বলল না। রানার প্রতি তার বিস্ময় আরো যেন বেড়ে গেল।
রানা তিতিরের মুখের দিকে একটু ঝুঁকে বলল, তিতির ফাদারের ঘরে আজ পর্যন্ত যে ফাদাররা এসে থেকেছেন, কারুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই জন্য এই চার্চটা আজ প্রায় দুশো বছর ধরে এরকম অবস্থায় পড়ে আছে। কেয়ারটেকার যে আছে, সে নিজেও রাত্রে থাকার সাহস পায় না। আমি তোমাকে এরকম একটা পরিবেশে কাউন্সিলিং করাতে চাই, কারণ এরকম একটা পরিবেশে তোমার ভেতর থেকে অনেক আবর্জনা বেরিয়ে আসবে আর তুমি কাল সকাল থেকে সুস্থ হয়ে উঠবে।
ফাদারের ঘরে এসে তিতিরে কিন্তু ভয় লাগেনি, বরং ঘরটা বেশ রোমান্টিক লেগেছিল তার কাছে। সে মনে মনে ভেবেছে, রানার মতন একটি ছেলের সাথে এরকম পরিবেশে রাত কাটানো কি খুব সাধারণ কোনো ঘটনা, না এর পেছনে ঈশ্বরের অন্য কোনো ইচ্ছে আছে?
তিতির সে রাতে রানাকে নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়েছিল। রানা তার দু-হাতের নখ দেখে বলেছিল, যে সে কাজ তিতির নিজে করেছে। মানুষ অনেক সময় নিজে কোনো কাজ করে ভুলে যায়, তারপর সে ভাবে সেই কাজ অন্য কেউ করেছে। তিতিরের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। রানা তিতিরকে বলে, তোমার সাথে যেটুকু কথা বলে বুঝেছি তোমার কোনো সঙ্গী নেই। এই বয়সের কোনো মেয়ের পুরুষ বন্ধু না থাকা অস্বাভাবিক। নিঃসঙ্গতা থেকে অনেক সময় এরকম সমস্যা তৈরি হয়।
রানা কথাগুলো শেষ করার আগেই ঘরের আলোটা নিভে যায়। সে অন্ধকারে কথা বলে চলেছে। তিতির সেই কথা অনুসরণ করে রানার পাশে এসে বসে। সে বলে, আলোটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন? এরকম হবার কথা তো না।
রানা তিতিরের হাত দুটো ধরে বলল, কোথায় আলো বন্ধ হয়েছে, আমি তো সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পারছি। তাছাড়া এতো বেশি আলো কাউন্সিলিং-এর সময় থাকা উচিত না।
তিতিরের খুব ভয় করছে, ভয়ে তার ঘাম হচ্ছে। মানুষ যখন খুব ভয় পায়, তখন তার গলার মাংশপেশি সঙ্কুচিত হয়ে যায়। এই মুহূর্তে তারও তাই হচ্ছে। সে রানার আরেকটু কাছে এসে বসল। তারপর বলল, এ আপনি কি বলছেন, আমি তো দেখছি চারদিক অন্ধকার।
রানা তিতিরের দু-হাত শক্ত করে ধরে বলে, তোমার মানসিক সমস্যা আছে। তুমি নিজের মনে কথা বলো, তুমি বোঝনা, কিন্তু আমি প্রথম দেখায় তা বুঝতে পেরেছি। আমি একজন সাইকোলজিস্ট, আমি যা বুঝতে পারছি তা তুমি বুঝবে না।
তিতির তার শরীরে একজন পুরুষ গরম নিঃশ্বাস অনুভব করছে। এতো কাছাকাছি সে এর আগে কোনো পুরুষের আসেনি। রানার শরীর দিকে এই মূহুর্তে তীব্র কোনো হরমোন ক্ষরণ হচ্ছে, যার গন্ধ তিতিরের শরীরকে উত্তেজিত করছে। তিতিরের জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে। এটা যে শুধু ভয় থেকে হচ্ছে না তা বোঝার মতন বুদ্ধি তার আছে। তিতিরের সারা শরীর কাঁপছে। সে অনুভব করছে, তার সামনে যে বসে আছে, সে তার মতন এতো উত্তেজিত না, সে স্থির হয়ে আছে। দূর্যোগ আসার আগের মূহুর্তে প্রকৃতি যেমন স্থির থাকে, এই মূহুর্তটাও যেন ঠিক সেরকম। তিতিরের নিজেকে সাইক্লোনের মতন মনে হচ্ছে আর রানাকে কোনো এক বন্দর।
রানা ঠিক করে নিয়েছে, সে কোনো দূর্বলতা দেখাবে না, যা ঘটার তা ঘটবে। কিন্তু এর কোনো দায় তার না, কারণ সে নিজে থেকে এগিয়ে কিছু করেনি। দিনকাল যে ভালো না সে তা জানে। এই একই ভাবে তার এক বন্ধু ফেঁসে গেছিল। তাই রানা সেদিন শুধু তিতির নামের সাইক্লোনের অপেক্ষায় বন্দরের মতন বসেছিল।
সব কিছু খুব তাড়াতাড়ি হল। তিতির নিজের হাত রানার থেকে ছাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে। কি হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে এতদিন ধরে এই অবলম্বন সে খুঁজেছে। রানা তিতিরের মুখ দু-হাতে ধরে তার ঠোঁটে চুমু খেলো। এই প্রথম চুমুর স্বাদ পেলো তিতির। সারা শরীরটা কাঁপছে। রানা অনুভব করছে তিতিরের তৃষ্ণা সহজে মেটবার না। আর তার আনাড়ি চুমু খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এটাই তার প্রথম অভিজ্ঞতা।
কতক্ষণ যে তারা এরকম ভাবে ছিল তিতিরের মনে নেই। এক সময় সে রানাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, একবার যখন পেয়েছি, তোমাকে ছাড়বো না রানা।
রানা বলেছিল, তিতির তোমার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছে আজ, কিন্তু তুমি একবারও তোমার বাবা, মায়ের কথা আমাকে বলোনি।
রানা অনুভব করছে তিতির কাঁদছে। সে রানাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরেছে। রানা অনুভব করছে মেয়েটি সম্পূ্র্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ করতে চায় তার কাছে। রানা তাকে প্রশ্ন করলো, তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?
তিতির বলল, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি বলেই তো তোমাকে পেয়েছি।
রানা বলল, তুমি জানো যারা মানসিক রুগী হয় তারা ঈশ্বরে সব থেকে বেশি বিশ্বাস রাখে। তুমিও রাখো। দেখেছো তো আমি ঠিক ধরেছি। আজ থেকে আর করো না কেমন। আজ থেকে আমাকে বিশ্বাস করো দেখবে তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। রানা বুঝতে পারছে তিতির ঘুমিয়ে পড়েছে। তার চোখ দুটো বন্ধ। সে তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তিতির এখন দেখো তো তুমি আলো দেখতে পাচ্ছ নাকি? আমি জানি তুমি এখন সব কিছু দেখতে পাবে।
তিতির যেন এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। সে চোখ খুলে দ্যাখে ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে সে রানাকে জড়িয়ে বসে আছে। এতক্ষণ কি ঘটেছে, সে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। একবুক আশঙ্কা আর লজ্জা নিয়ে তিতির উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য দরজার দিকে গেল, ঠিক তখন রানা বলে উঠল, তিতির, কাল তাহলে ঠিক এই সময় দেখা হবে।
তিতির দাঁড়িয়ে পড়ে , বলে, কোথায়?
রানার মুখে রহস্যময় হাসি, সে বলে সেটা সময় মতন তোমাকে জানিয়ে দেবো, কেমন?
তিতির লক্ষ্মীমেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে দরজার ফাঁক দিকে সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়া ঘরে এসে ঢোকে।
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস খাতা লিখেছেন দেবশ্রী চক্রবর্তী