ছোটগল্প
বৃত্ত
সৌরভ আহমেদ সাকিব
Illustration: Preety Deb
দক্ষিণ পূর্বের জানলাটা এখনও সেভাবেই খোলা। ধূসর স্মৃতিরা গাঢ়তর হয়ে মিশে গেছে সিগারেটের ছাই-এ। জীবন নামের জিজ্ঞাসার পিছনে পিছনে ছুটে ছুটে তার বিসর্গ বিন্দুও ছুঁতে পারেনি বিমল। তেত্রিশ বছরের জীবনের এই রেলগাড়িতে শুধু কামরা বদলই হয়েছে। গন্তব্য তার আজও দূর-অস্ত। সত্তা শূন্যতার দ্বান্দ্বিকতায় বিপন্ন মানব জীবন যখন হিমশৈলের মত ভাসমান; বিমল তখন ভাঙা জানালার ফ্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে নিত্য খুঁজে ফেরে তার পরিচয়কে।
দু’পা এগিয়ে জানলাটাকে ছুঁতে পেল বিমল। বাঁ হাত দিয়ে অভ্যস্ত ভঙ্গীতে জানলার পর্দা সরালো। রঞ্জিতা এখন ও ঘরে…।
অফিসে ফাইলের পাহাড় যেভাবে জমে উঠছে, শেষে সে নিজেই না ফাইল বন্দি হয়ে যায়! কর্মব্যস্তময় জীবনে এই প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে ক্রমশ সে যেন বিতৃষ্ণ হয়ে উঠছে। অফিস গেলেই কানে সেই পলিটিক্যাল বিতর্ক, রেপ, খুন, পরকীয়া…। অসহ্য হয়ে উঠছে চারপাশ। শশী প্রদীপের সম্পর্কটাও উত্তর দক্ষিণ মেরুতে এসে ঠেকেছে। রঞ্জিতার কাশিটাও বড্ড কানে লাগে ইদানীং। ওর চেক আপ দরকার। “চেক আপ দরকার”। বিড়বিড় করে বিমল।
টেবিলে ফিরে এল বিমল। ডায়েরি লেখার চিরায়ত অভ্যাসে আজও ভরে গেল কয়েকটি খালি পৃষ্ঠা। বিমলের মনে হয় –
সময়ের চোরাবালিতে গলা ডুবিয়ে কেন যে মানুষ জীবনের রূপ রং রস পেতে চায়! কে জানে! অনেকেই তো বীতস্পৃহ।
প্রতিবেশীর ঘরের আলো দেখে বিমল অনুভব করে- এখন রাত কমবেশি সাড়ে বারো। টেব্ল ছেড়ে আবার চলে আসে জানলায়। রাতের গভীরতা বাড়তেই থাকে। আর বাড়তে থাকে বিমলের অস্তিত্ব সংকট।
সকালে চায়ে চুমুক দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল বিমল। আপন মনেই গেয়ে উঠলো
-“ওরে মন, ও উদাস পাগল মন, বলি তুই আমার কথা শোন। চল জটিল হয়ে যাই”।
অফিসে গিয়ে দেখলো আজ অনেকেই আসেনি। স্মৃতি, সপ্তপর্ণা, অনিন্দ্য সান্ন্যাল আরও অনেকে। পুজোর গন্ধে সবাই শপিং ডেটিং এ মেতে উঠেছে।অলসতা আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরছিল।
ক্লান্ত দু’চোখে কখন যে নেমে আসে ঘুমের ছায়া…
-স্যার।
ঘুম ভেঙে যায় বিমলের। একটা নতুন পত্রিকা।
নূরজামানের পত্রিকা ‘ সময়’। আজ হঠাৎ কী মনে করে! কিছুটা বিস্মিত হয় বিমল। নূরজামান এখন বেশ প্রচার প্রসার পেয়েছে। কিন্তু এদিন পর হঠাৎ…! তার অফিসের ঠিকানা সে কী করে পেল! তার শেষ লেখা ‘সময়’ এ প্রকাশিত হয়েছিল, সে তো ছ’বছর আগে। তারপর দু’জনের ভিতর তৈরি হয়ে যায় কমিউনিকেশন গ্যাপ। নূরজামান এর আর বিমলকে প্রয়োজন পড়েনি। তারপর একের পর এক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে বিমল। বাবার মৃত্যু, মায়ের সাডন্ স্ট্রোক…
পড়াশুনোর পালা শেষ করেই চাকরির ফিকির।
শেষে চাকরি জুটে যাওয়া ও রঞ্জিতাকে ঘরের বউ করে আনা। তারপর থেকে ঐসব বুদ্ধিবাদের চর্চা গোল্লায় গেছে। এখন ওসবে তার অপ্রতিযোজন। হারিয়ে গেছে তার কবিতা লেখার পাগল অভ্যাস। একদিন কবিতার জন্যই
সে ছুটে ছুটে গেছে কোথায় না কোথায়।
এখন সবই ইতিহাস…
তীব্র শব্দে বিমানটা বেঁকে যায় এয়ারপোর্ট এর দিকে। শরতের আকাশে ঝলমল করে মেঘ। দুপুরের নির্জনতায় যেন ঘুমিয়ে আছে শহরের বহুতল। মাঝে মাঝে হাওয়ায় দুলে ওঠে ছাদে মেলে দেওয়া কাপড় জামা। কয়েকটি কাক চুপ করে জলের ট্যাঙ্কের উপর বসে থাকে। পরিচিত এই ছবি বিমলকে তবু উদাস করে। একদিন এই শহরকে নিয়ে তার দারুণ আবেগ ছিল। তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিকেলে যখন সে মেসে ফিরত তখন শহরের অন্য চেহারা…
বিকেলে রঞ্জিতার সঙ্গে গল্প করছিল বিমল। বোকার মত তাকিয়ে ছিল রঞ্জিতার দিকে।
আদর করে রঞ্জিতাকে সে কবিতা বলে ডাকে।
আলগোছে পিঠের চুল সরিয়ে বিমলের দিকে তাকায় রঞ্জিতা। শুকনো মুড়ি চিবোতে চিবোতে বিমল আলমারি খোলে। ঝরে পড়ে একরাশ ধুলো। রঞ্জিতা মুখে আঁচল দিয়ে পিছনে সরে গেল। ধুলো মাখা বইয়ের মলাটে হাত বুলিয়ে বিমল বলে-
“জানো, এই বইটা কার?”
রঞ্জিতা এদিক ওদিক ঘাড় নাড়ে।
-এটা সার্ত্র’র – Being and Nothingness
এইটা Eliot এর The waste Land.
এরপর স্মৃতির সুতোয় ভর করে বিমল ফিরে যায় তার কলেজ জীবনে। তার অতিপ্রিয় কলেজ জীবন। প্রিয় শিক্ষক অনিমেষ বাবু তাকে বারবার বোঝাতেন Theory of inspiration এর তত্ত্ব। একাধিকবার ঠোঁট ফেটে
বেরিয়ে এল inspiration, alienation, self projection… আরও নানা অর্ধ অনুচ্চারিত শব্দ। রঞ্জিতার বোধগম্য হল না কিছুই। তারপর বই হাতড়ে বিমল রঞ্জিতাকে দেখাতে চায় –
এই দ্যাখো, স্যার লিখেছিলেন –
“উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষ্যে অগ্রসর হও”।
অদম্য আবেগে বিমল যখন ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির গহীনে, রঞ্জিতা তখন অনুভব করে বিমলের নিঃসঙ্গতা। তার কাতরতা। অনুভব করে বিমলের স্বেচ্ছানির্বাসনের দায়বদ্ধতাকে।
অনুভবী বিমল কাঁদতে পারেনা, হাঁফায়। বুকের উপরের অদৃশ্য পাথরটাকে সে কীভাবে সরায়।
যেখানে সমগ্র মধ্যবিত্ত তোষামোদ, খোশামোদে গতি পায় সেখানে বিমলের প্রগতির বাহন আর কী বা হতে পারে! মাস মাইনে, পরনিন্দা, পরিচর্চা আর প্রতি রাতের ব্যর্থ সঙ্গমের অতৃপ্তি…
আর কী?
তুমি হারিয়ে গেলে খুঁজে পাবো
ছুঁয়ে ছুঁয়ে এঁকে নেবো
তিন এক্কে তিন।
রাতের ভিতর শালীনতা!
লাভার কূপে স্বচ্ছলতা
এক বিন্দু স্বস্তি তুমি
দুটি ঠোঁটে পেলবতা…
আর বিমল সেই অতৃপ্তি, মনোবিকারকে দূরে ঠেলে ফেলে, প্রতি রাতে জানলার ফ্রেমে হয়ে ওঠে মধ্যবিত্তের প্রতিভূ এক জীবন্ত জীবাশ্ম।
কর্মব্যস্ততায় তার বিচরণভূমি সংকীর্ণ হতে হতে, সে রঞ্জিতার কাছে আজ এক আস্ত ফাঁপা মানুষ। দীর্ঘ দাম্পত্যেও সে প্রশমিত করতে পারেনি রঞ্জিতার নান্দনিক যৌনতাকে।
অফিস, রঞ্জিতা, টেবিল এই ত্রিকোণ ফ্রেমে সে নিজেই রচনা করেছে এক অদৃশ্য ত্রিশূল।
আজ সন্ধ্যায় বিমল একবুক আবেগে ভেসে এল রঞ্জিতার কাছে। ঘুমন্ত রঞ্জিতাকে কাছে টেনে নিল নিবিড় আলিঙ্গনে। তারপরে কেটে যাওয়া কিছু উথাল পাতাল মুহূর্ত…
রঞ্জিতা ধীরে শ্বাস ফেলে। সারা ঘর জুড়ে বয়ে চলে নৈঃশব্দ্যের ঝড় ও দুটি বুকের ওঠাপড়া।
তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে নেশাগ্রস্ত বিমল আবার ফিরে আসে নিজের টেবিলে। হাতে কলম গুঁজে ফিরে দেখে রঞ্জিতাকে। আবার বন্ধ চোখে পাড়ি দেয় তার নিঃসঙ্গতার বলয়ে…
আরও পড়ুন: রবিবারের ছোটগল্প সেদিনও আকাশে তারা ছিল লিখেছেন রুনা তাসমিনা
No comments
Pingback: রবিবারের ছোটগল্প রামদুলালের ঢোল লিখেছেন মিলন বনিক » সবার খবর