Home / রবিবারের আড্ডা / গল্প / রবিবারের ছোটগল্প ল্যান্ডফোন লিখেছেন তাহমিনা শিল্পী

রবিবারের ছোটগল্প ল্যান্ডফোন লিখেছেন তাহমিনা শিল্পী

ছোটগল্প

ছোটগল্প

Illustration: Preety Deb

আজ খুব উৎফুল্ল আর চনমনে মুডে স্কুল থেকে ফিরল সৌর।ব্যাগটা সোফায় রেখেই মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,জানো মা আজ সুমায়তা আমাকে প্রপোজ করেছে।একটা চিঠিও দিয়েছে।
তারপর ব্যাগ থেকে চিঠি বের করে মাকে দেখালো।

১৩ বছরের সৌর’র কথা শুনে মা রীতিমত হতবাক।এইতো সেদিন ছোট্ট সৌরকে কোলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরল। আর আজ তাকেই মেয়েরা প্রেমের প্রপোজাল দিচ্ছে!কী হচ্ছে এসব!শেষ পর্যন্ত ছেলেটার ভবিষ্যৎ না নষ্ট হয়ে যায়।এসব ভাবতে ভাবতে মা চিঠি খুলে পড়ছে-

প্রিয় সৌর,
তোমাকে দেখতে ঠিক আমার স্বপ্নের নায়ক শাহরুখ খানের মত।কি ভালো ক্রিকেট খেলো তুমি।পড়াশুনায়ও কত্তো ভালো।তোমার কথা,এটিট্যুট সবকিছু জাষ্ট ওসাম।আমি তোমার উপর সিরিয়াসলি ক্রাশ খাইছি।আমিতো ক্লাসের সময় শুধু তোমার দিকেই তাকিয়ে থাকি। অথচ তুমি কিছুই দেখতে পাও না।জানো,আমার সব বান্ধবীরা হিংসায় মরছে।
তোমার কি মত চিঠিতে জানিও।না জানালে কিন্তু আমি মরেই যাবো।
লাভ ইউ,লাভ ইউ সো সো সো মাচ্‌।
ইতি,
সুমায়তা

সৌর হাসছে আর বলছে,বলতো মা এইটা কোন কথা!এতো ছোট কারণে কেউ মরে যায়?
মা ভাবছে সে কি সৌরকে শাসন করবে নাকি বুঝিয়ে বলবে।বোঝালেই কি সৌর বুঝবে?অবশ্য সৌর তার বয়সের আর পাঁচটা বাচ্চার মত নয়।সারাদিনের সব কথা মায়ের সাথে শেয়ার করে।বাবা-মায়ের সাথে তার সম্পর্ক বন্ধুর মত।তারা একসাথে গল্প করে।বেড়াতে যায়,মুভি দেখে।মা কিছুটা ভরসা পায় মনে।
রাতে সৌর’র বাবা বাসায় ফিরলে মা তাকে সব জানালো।বাবা সৌরকে ডেকে বলল,শোন ১৩ থেকে ১৯ বছরকে টিন এইজ বলে।এই বয়সে অদ্ভুত সব অনুভূতি হয়।অকারণে সব ভালো লাগে।হঠাৎ কিছু ভালোলাগলে কেমন একটা নেশার মতো হয়ে যায়।মনে হয় এটা না পেলে বুঝি মরেই যাবো।কাউকে পছন্দ হলে রাত জেগে কবিতা লেখা,যেন মস্ত বড় এক কবি! আবার বড়দের কাছে ধরা পড়ার ভয়ে সব ছিড়ে-ছুড়ে ফেলা।ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দেখা করার জন্য ব্যাকুলতা।ধরা খেয়ে প্রেম হারিয়ে গেলে সব কিছু অসহ্য লাগে।আবার একটা নিদির্ষ্ট সময় পর সেই নেশা কেটে যায়।তখন বোকামি গুলো ভেবে ভীষন হাসি পায়।কিন্তু এই সময়ের অনুভূতিকে সাহস আর মনবল দিয়ে জয় করে মন দিয়ে পড়াশুনা করতে পারলে জীবনে সে বড় হতে পারে। তার জন্য সুন্দর সব প্রাপ্তির দ্বার খুলে যায়।
সৌর মন দিয়ে বাবার কথা শুনতে থাকে। আর বাবা কথা বলতে বলতে স্মৃতির নদীতে জাল ফেলে।
১.
কদিন ধরেই ঘোর বর্ষণ চলছে।আজ শেষ বিকেলের দিকে আকাশটা একেবারে ঝরঝরে পরিষ্কার হলেও মাঝরাতে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল।আধো আধো ঘুম চোখে ফিজিক্স প্রাকটিক্যাল খাতায় বাড়ীর কাজ করছে একাদশ বর্ষে পড়া ছেলেটি।হঠাৎ বৃষ্টির তালের সাথে সুর মিলিয়ে বাড়ির ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলো মিহি সুরে।
প্রায় দৌড়ে গিয়ে রিসিভার কানে ধরতেই অপরপ্রান্ত থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি ফিসফিস করে নাকি সুরে বলল-
-হ্যালো? কি করছো?
কণ্ঠে অভিমান নিয়ে ছেলেটি বলল,
-এতোক্ষণে সময় হলো? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি।
-আহারে!বাসার সবাই না ঘুমালে ফোন দিবো কি করে?
-তাইতো,আমার বাসাতেও সবাই ঘুমাচ্ছে। শোন না,আজকের রাতটা ভীষণ সুন্দর!তুমি ফোন করেছো এখন আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে।
: ইশশ! শুধু বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা।সেই ক্রস কানেকশনের পর থেকেতো রোজ আমিই তোমায় ফোন দেই।তুমিতো কখনও ফোন করোনি আমায়।
-তুমিতো আমাকে তোমার ফোন নং দাওনি।বলেছো বাড়িতে ধরা খেলে খুব বকবে।তাই তুমি-ই ফোন করবে।এখন আবার খোটা দেয়া হচ্ছে?আচ্ছা,যাও-আর কখনও ফোন করতে হবে না।
-আরে!আমিতো ফান করলাম।হিহিহি…
-আবার হাসা হচ্ছে খুব? ছেলেটির কণ্ঠে কপট রাগ।
-আহা,রাগ করো না প্লিজজজ।এই যে কান ধরেছি।
-আচ্ছা যাও এবারের মত মাফ করে দিলাম। হাহাহা…
হঠাৎ মেয়েটি গলায় যথাসম্ভব আবেগ ঢেলে বলল,
-চল না,কাল আমরা দেখা করি?
-কাল!কেনো বলতো?
-অনেক তো ফোনে কথা বললাম।এবার তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।আসো না প্লিজজজ।
-কিন্তু তোমার মা তো তোমার সাথে থাকে।উৎকণ্ঠা নিয়ে ছেলেটি বলে।
-সে আমি ম্যানেজ করে নিবো।কিন্তু কাল তোমাকে দেখতে না পেলে আমি মরেই যাবো।
-অমন কথা বলো না প্লিজজজ।ছেলেটির বুকে ব্যথা বাজে।বলল,
-আচ্ছা,কখন,কোথায় আসবো?
– সকাল ঠিক ১১টায় আমার স্কুলের সামনের ফাস্টফুড শপের দুইতলায় থাকবে।
-আমাকে চিনতে পারবে তো?
-হুম,পারবো।তুমি তো তোমার কলেজের ইউনিফর্ম পড়ে থাকবে,তাইনা?
-হুম,আর তুমিও নিশ্চই তোমার স্কুলের ইউনিফর্ম পড়া থাকবে। হাহাহা…
-হাসছ কেন?
-তুমি শাড়ী পড়ে এলে খুব ভালো হত।লাল শাড়ীতে তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
-শখ কত! স্কুল ফাঁকি দিয়ে শাড়ী পড়ে আসবো? হিহিহি…
-তাহলে আমিও পাঞ্জাবী পড়ে আসতাম। হাহাহা…
বৃষ্টির শব্দের সাথে মিলিয়ে যায় তাদের হাসির রেশ।
কিছুক্ষণ পর মেয়েটি উদাস কন্ঠে বলে,

-আচ্ছা,আমি যদি দেখতে সুন্দর না হই?
-সুন্দর কি আমি তা জানি না।তবে রোজ সকালে ঘুম ভেঙে আমি বিছানার পাশের জানালা দিয়ে তাকালে এক টুকরো নীল আকাশ দেখতে পাই।আমার কাছে সে সুন্দর।পূর্ণিমার রাতে আমার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে যে চাঁদটা দেখতে পাই,সে সুন্দর।অনেক বৃষ্টি হবার পর গাছের পাতায় লেগে থাকা জল সুন্দর।আর সুন্দর তু্মি।
ছেলেটির গলায় মাদকতা।মেয়েটি ডুকরে কেঁদে ওঠে।ছেলেটির ভীষণ কষ্ট হয়! সে বলে-
-কি হল! কাঁদছো কেন? আমি কি তোমাকে কষ্ট দিলাম?
-না না,আনন্দে কান্না চলে আসলো।
দেয়াল ঘড়ি জানান দিলো রাত তিনটা।
-ছেলেটি বলে,ঘুমাবে না?
-হুম,তাহলে এখন রাখি।কাল দেখা হবে।দেরী কোরনা কিন্তু।এক মিনিট দেরী হলেও আমি ঠিক মরে যাবো। হিহিহি…

২.
সেদিন ছিলো কড়কড়ে রোদেলা দিন।ফাস্টফুড শপে স্কুল ও কলেজ ফাঁকি দিয়ে মুখোমুখি বসে আছে দুজন।নিরবতা ভেঙে মেয়েটি আহ্লাদি গলায় বলে ওঠে-
-শোন,আজ আমার জন্মদিন।আমাকে খুব সুন্দর কিছু বল,তানা হলে কিন্তু মরে যাবো।
-শুভ জন্মদিন।অনেক শুভেচ্ছা তোমায়।
মেয়েটির আশাহত মুখে মেঘ জমে ওঠে।ছেলেটি তার অনুভূতি বুঝতে পারে।টেবিলের উপরে রাখা মেয়েটির হাতটা শক্ত করে ধরে কাঁপা হাতে চিবুক ছুঁয়ে বলে-
-তুমি আমার হয়ে থেকো, হারিয়ে যেওনা কোনদিন।
আনন্দে মেয়েটির চোখ ছলছল করে ওঠে।গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে।
সেদিন ফাষ্টফুড শপ থেকে বের হতেই মেয়েটি ধরা পরল তার মায়ের কাছে।
ছেলেটির বাড়ির ল্যান্ডফোনে আর কোনদিন মেয়েটির ফোন এলো না।ছেলেটি কিছুদিন অপেক্ষায় থাকলো।মন খারাপ করলো।তারপর সব ভুলে গেলো।

৩.
ছুটির বিকেল।সারাদিন একটানা বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই।কমার কোন লক্ষন নেই।রাস্তায় এক হাঁটু জল জমে আছে ।স্ত্রী-পুত্রসহ শপিংয়ে এসেছিল ছেলেটি।শপিং মল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।তখন এক সুখি দম্পতি বেরিয়ে এলো শপিং মল থেকে।তার প্রায় পাশ ঘেসে দাঁড়ালো মেয়েটি।কিন্তু তাকে দেখতেই পেলনা।বয়স বেড়েছে তবে সেদিনের ফাষ্টফুড শপের চেয়ে আজ যেন একটু বেশি-ই সুন্দর লাগছে।মেয়েটির হাত ধরে থাকা শিশুকন্যাটি কেন যেন ঝর্নার মত খলখল করে হাসছে।হিহিহি…
বৃষ্টির শব্দের সাথে মধুর সিম্ফনি অনুরণিত হল সেই হাসির শব্দ।ছেলেটির মনে স্মৃতির ঘোর লাগলো।
লাল শাড়ির আঁচল উড়িয়ে বাতাসে বিষাদ ছড়িয়ে এলিয়েন কারে চেপে চলে গেল মেয়েটি।
Read More: রবিবারের ছোটগল্প আলোর ঘ্রাণ লিখেছেন দেবপ্রিয়া সরকার

Check Also

গল্প

রবিবারের ছোটগল্প আলোর ঘ্রাণ লিখেছেন দেবপ্রিয়া সরকার

ছোটগল্প Illustration: Preety Deb রাত তখন দুটো কী তিনটে হবে। অভ্যেস বশে পাশ ফিরে মেহুলকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *