দেবশ্রী চক্রবর্তী: ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত একখন্ড মরুপ্রান্তরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে রহস্য এবং রোমাঞ্চ। আমি ব্যক্তিগতভাবে এইরকম রহস্য রোমাঞ্চের আলো আঁধারি পথ দিয়ে চলতে ভালোবাসি। তাই রাজস্থান আমার প্রিয় গন্তব্যের অন্যতম। থরমরুভূমির মাঝে শুঁকনো মরুখাতে এখনো কান পাতলে শোনা যায় অতীতের কোনও এক লুপ্তপ্রায় সভ্যতার চলমান স্পন্দন। কিংবা যাযাবরদের দ্বারা যুগ যুগান্তর ধরে লালিত লোকগাঁথার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় ঢোলা মারুর করুণ প্রেম কাহিনী। আমরা সবাই কম বেশি রহস্য ভালোবাসি। নিজেদের নিত্য জীবনের এক ঘেয়েমি কাটানোর জন্য আজ এমন এক জায়গার খোঁজ দেবো, যেখানে এক রাত কাটিয়ে আসতে পারেন।
গত বছর অক্টোবরে আমরা রাজস্তানের কিরারু গ্রামে একরাত কাটাতে গেছিলাম। কলকাতা থেকে যোধপুরের বিমানে চড়ে আমরা নবমীর দিন রওনা হয়েছিলাম। বিকেল পাঁচটার ফ্লাইট ছিল। আমাদের যোধপুর পৌঁছোতে রাত দশটা বেজে গেছিল। কারন ফ্লাইটি জয়পুরে আধ ঘণ্টা থেমে কয়েকজন যাত্রী নামিয়ে কিছু নতুন যাত্রী নিয়ে তবে যোধপুরের দিকে রওনা হয়। সেই রাতে আমরা যোধপুরের হোটেল শ্রী রাম-এ রাত কাটাই। তারপর পরেরদিন যোধপুর শহর থেকে একটা ইনোভা গাড়ি নিয়েআমরা বারমেরের পথে যখন রওনা হলাম, তখন সকাল দশটা বাজে। আমরা পথের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছিলাম। তবে আপনারা যদি ট্রেনে যেতে চান, তাহলে খরচাটা অনেকটাই কম পড়ে। যোধপুর থেকে হাইওয়ে দিয়ে যখন যাত্রাশুরু করি, তখন শ্যামল-সবুজ প্রকৃতির মাঝে হাল্কা হলুদ বালুরাশি আমাদের আপ্লুত করে। ধীরে ধীরে সবুজ গাছপালা উধাও হতে শুরু করে, সেই সাথে রাস্তার দুই ধারে হলুদ মরু প্রান্তর শুরু হয়। তপ্ত বালুরাশির মাঝে কিছু ক্যাকটাস জাতীয় গাছ চোখে পড়ে। ধু ধু করছে চারিদিক। জন-বসতি নেই বললেই চলে। প্রান্তরের মাঝে মাঝে দু-একটি অস্থায়ী বসতি এবং কিছু পশুপালকদের দেখা মেলে। কিন্তু সব থেকে আমাদের অবাক করেছিল এই জনহীন প্রান্তরেও এটিএম কাউন্টার ও ঝাঁ চকচকে রাস্তার দুই ধারে ফুটপাথ। রাজস্থানীরা রঙের বৈচিত্র পছন্দ করেন। এই জন্যই হয়ত নানা রঙের বোগেনভেলিয়া ফুলের বৈচিত্র্যময় উপস্থিতি দেখা মিলেছিল রাস্তার দুই ধারে। প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য আমাদের বিভোর করে দিয়েছিল। এক সময় জোরে ঝাঁকুনি আসাতে হুঁশ ফিরে আসে। সামনের দিকে বিশাল উটের দলের উপস্থিতি অনুভব করি। ছোট উট থেকে বড়ো, বিভিন্ন মাপের উট এই দলে দেখতে পাই। উটগুলো বেশ শৃঙ্খলতা রক্ষা করে রাস্তার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলতে থাকে। উটগুলো চলে গেলে পাগড়িবাঁধা এক বৃদ্ধের দেখা মেলে। আমি গাড়ির চালককে প্রশ্ন করলাম, ইনি একা এতগুলো উটকে নিয়ে যাচ্ছেন? উত্তরে তিনি বললেন, না , সামনে দুটি ছেলে ছিল, আমি লক্ষ করিনি।
বারমেরে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের দুপুর দুটো বেজে গেল। এখান থেকে কিরারু আর এক ঘণ্টার পথ। চালকভাই জানালেন, পথে কোনও জনবসতি নেই, তাই আমাদের বারমেরে খাওয়া-দাওয়া সেরে তবে রওনা দিতে হবে। আমরা ঠিক করলাম স্থানীয় ধাবায় রাজস্থিনী খাবার খাবো। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতরে বসে বাইরের তাপমাত্রা বোঝা সম্ভব না। তাই আমরা যখন গাড়ি থেকে বাইরে বেরোলাম, মনে হল, আমাদের সারা শরীর সূর্যের প্রচণ্ড তাপে ঝলসে গেল। কোনও ক্রমে ধাবার ভেতরে ঢুকে ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম। বিশাল বড় একটা বট গাছের নীচে এই ধাবা। বড় বড় ডেকচিতে নানা রকম রাজস্থানী খাবার রাখা। সাংগরি, ডাল, নানা রকম সবজী, বাজরার রুটি, উটের দুধের দই এসব রাখা। থালা-বাসন বেশ পরিষ্কার দেখলাম এবং আশেপাশে কোনও মাছির দেখা পেলাম না। যাবার সাথে সাথে বিশাল বড় একটা মাটির মটকা থেকে গ্লাসে করে জল এনে দিলো একটি ছেলে। জলে চুমুক দিয়ে মনে হল যেন ফ্রিজের জল খাচ্ছি। যাই হোক, পেটভরে খাবার খেয়ে আমরা কিরারুর পথে রওনা দিলাম।
বারমের শহর থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়েই শুরু হল বর্ডার রোড। ঝাঁ চকচকে চওড়া রাস্তা আর দুই ধারে মরুভূমির মাঝখান দিয়ে গাড়ি ছুটল। দূর দূরান্ত পর্যন্ত কিছু চোখে পড়েনা। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু বালি। এইভাবে যাচ্ছিলাম, এক সময় একটা ভাঙ্গা দুর্গ চোখে পড়ল। চালকভাই বললেন, এক সময় এখানে এক রাজা থাকত। এখন আর কেউ থাকে না, তাই রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে এই অবস্থা। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, এত সুন্দর একটা দুর্গ কিভাবে অযত্নে শেষ হয়ে যাচ্ছে। হাইওয়েতে বেশ কিছু বি.এস.এফ-এর ট্রাক চোখে পড়ল। ট্রাকগুলোতে চড়ে সেনা ভাইরা যাচ্ছেন।এই গরমের মধ্যে কিভাবে যে তারা থাকেন ভেবেই অবাক হচ্ছিলাম। রাস্তা এক সময় ডানদিকে বেঁকে গেল। সেখানে স্থানীয় ঝাঁ চকচকে পঞ্চায়েত অফিস চোখে পড়ল, কিন্তু তাতে তালামারা। আর কিছুটা গিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র দেখতে পেলাম। কিন্তু একটা মানুষজনেরও চিহ্ন নেই কোথাও। মনে হল, মৃত্যু উপত্যকায় প্রবেশ করলাম আমরা। একটা লাল রঙ করা গেটের সামনে এসে চালকভাই বললেন, ম্যাডামজী পৌঁছগেয়ে। আমার স্বামী গাড়ি থেকে নেমে টিকিট কাউন্টারের কাছে গিয়ে দ্যাখে, টিকিট কাউন্টারও বন্ধ, কোনও মানুষজন নেই। মন্দিরটিও ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এর টিকিট কাউন্টার বন্ধ দেখে আমরা খুব অবাক হলাম।
এবার বলি, আমরা এই মন্দিরে কেন রাত কাটাতে গেছিলাম। এটি একটি অভিশপ্ত মন্দির! এমন মন্দির, যেখানে অভিশাপে মানুষ পাথর হয়ে যায়৷ এমনটাই কথিত আছে কিরারুতে অবস্থিত এই মন্দিরটি৷ সারারাত এই মন্দির চত্বরে থাকা মানেই আপনার মৃত্যু অনিবার্য৷ আমি এবং আমার স্বামী দুজনই রহস্য ভালোবাসি। তাই এইসব ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করার জন্যই আমরা ছুটে গেছিলাম। এখানে গুনে গুনে সাতটা সূর্য মন্দির আছে। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর জন্য একে রাজস্থানের খাজুরাহ বলা হয়। একসময়ে দ্বাদশ শতকে সোমেশ্বর রাজা এই মন্দিরে রাজত্ব করতেন৷ সেই সময় তুরাস্কস আক্রমণ করে এই শহরে আর সেই সময়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় মন্দিরটি৷ কথিত আছে, এক সন্ন্যাসী এই গ্রামে এসেছিলেন ভিক্ষা করতে। কিন্তু তিনি ভিক্ষা না পেয়ে অভিশাপ দেন যে, এই গ্রাম পাথরে পরিণত হবে।
গেটটাতে ধাক্কা দেবার সাথে সাথে একটা বিকট শব্দ করে তা খুলে গেল। আমি ভেতরে ঢুকে বেশ কিছু ময়ূরের পেখম খুঁজে পেলাম। চালকভাই আমার মেয়ের হাতে কয়েকটা পেখাম তুলে দিয়ে বললেন, এটা সঙ্গে থাকলে কোনও অশরীরী তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। আমি একটা পেখম তুলে নিলাম। দুই দিকে মরুগাছের ঝোঁপ আর মাঝখান দিয়ে বালির রাস্তা। কয়েকটা ছাগল, ভেড়া আর গরু দেখতে পেলাম, তারা ঝোঁপের থেকে পাতা খাচ্ছে, কিন্তু কোনও মানুষের…
আরও পড়ুন: রাজস্থান ভ্রমণ : জয়সালমীর থেকে কুলধারা একটি ভৌতিক নগরী
Check Also
রবিবারের ছোটগল্প শ্রীদেবী ও বংকু লিখেছেন তৃষ্ণা বসাক
ছোটগল্প Illustration: Preety Deb খবরটা যখন এল, তখন বংকু প্যান্টের পিসের ঝুঁকে পড়ে মোটা নীল …