ছুটির মেজাজে সমুদ্র থেকে পাহাড়ে
সা ন্ত্ব না স মা জ প তি
দৈনন্দিন কাজ এর চাপ ও একঘেয়েমি থেকে হটাৎ ৩ দিনের ছুটি। আমি আর আমার তিনি,ঠিক করে ফেললাম আবার একটু বেড়িয়ে পড়া যাক। বেশি দূরে নয়। কাছাকাছি কোথাও।শান্ত পরিবেশে। যেখানে পাহাড়, সমুদ্র, জংগল, গ্রাম্য সৌন্দর্য, প্রকৃতির হাতছানি, সব একসাথে উপভোগ করা যাবে। ঠিক হলো চাঁদিপুর যাব এবং আশেপাশেও ঘুরে দেখব। যেই ভাবা সেই কাজ, পরেরদিন গাড়ি করে বেড়িয়ে পড়লাম আমরা ৫ জন (বাবা,মা,আর আমরা ৩ জন)। আমার ছেলের উৎসাহ ছিল দেখার মতো। ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল একা-একাই।সকাল ৬.৩০ টায় বেরিয়ে পরলাম।শুধু কোলাঘাটে সকালের খাবারের জন্য দাঁড়ানো হয়েছিল।তারপর গাড়ি আর কোথাও দাঁড়ায়নি। যখন চাঁদিপুর পৌছলাম তখন ঘড়িতে ঠিক সকাল ১১.৩০। তারপর শুরু হল হোটেল খোঁজা।২৫ ডিসেম্বরের ভিড়ে হোটেলে রুম পাওয়া ছিল দুষ্কর ব্যাপার। অবশেষে ‘হোটেল চাঁদিপুর’- এ ঘর পাওয়া গেল। এবার নিস্চিন্ত; খাওয়া দাওয়া সেরে ছুটলাম সমুদ্র দেখতে।
কিন্তু হা ভগবান! কোথায় সমুদ্র!!!!!! এ-যে ধুঁধু মাঠ। যতদূর চোখ যায় শুধু ভেজা বালি। সমুদ্র অনেক দূরে, রেখার মতো দেখা যায়। বলতে বাধা নেই, হতাশ হলাম। এতটা পথ পেরিয়ে এসে; শেষে কিনা এই!কি আর করি, হেঁটে গেলাম, দেখলাম আর জয় করে ফিরে এলাম। ওখানেই বিচের সিঁড়িতে বসলাম। হঠাৎ মা গোমড়া মুখে বলে উঠল, ‘এর থেকে আমাদের গঙ্গার ধার ভালো’। অতিত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়তেই আমি প্রমাদ গুনলাম…। আমি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে সব জায়গার-ই একটা নিজস্বতা আছে, সব সৌন্দর্য সমান হয়না। তখন আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য মায়ের মনোরঞ্জন করা। সেখানেই একটা মার্কেট ছিল,কিছু কেনাকাটা করা হলো। সন্ধ্যেবেলা শুনলাম চাঁদিপুরের সমুদ্র নাকি রাতে কাছে চলে আসে।ভোরবেলা আবার দূরে সরে যায়। আশায় বুক বেঁধে আমরা কাছেই ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম ।পাশেই ছিল রাধাগোবিন্দ মন্দির।সেখানে ভালো একটি পার্ক আছে।বোটিং করার জায়গাও আছে। আর একটু দূরে মোহনা, দেখে এলাম…।ভালো-ই লাগলো । খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার গেলাম দেখতে, যদি সমুদ্র কাছে আসে,কিন্তু হায়! কোথায় কি! বিফল মনোরথে যখন ঘুমতে যাবো, তখন হোটেলের দাদা কয়েকটি জায়গার কথা বললেন।প্রথমে বালেশ্বর থেকে গিয়ে ক্ষীরাচোরা গোপিনাথ মন্দির… তারপর ইমামি জগন্নাথ মন্দির। সেখান থেকে দেবকুন্ড। তারপরে দুপুরের খাবার খাওয়া হবে উদালাতে। ওখান থেকে তারপরে যেতে হবে পঞ্চলিংগেশ্বর , নীলাগিরি ইত্যাদি জায়গাগুলিতে । আমরা নিজেদের মতো করে রুট সাজিয়ে নিলাম। সারাদিনের ধকলে শরীর ক্লান্ত থাকায় সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়লাম। এক রাত পেরিয়ে গেল ।…
পরেরদিন সকাল ৭ টায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমেই গেলাম ক্ষীরাচোরা গোপিনাথ মন্দিরে। ছোট জায়গা নিয়ে মন্দির, কিন্তু মন্দিরের ভেতরের পরিবেশে যেন এক স্বর্গীয় শান্তি বিরাজমান। মনটা শান্ত হয়ে গেল মু্হুর্তে ।এই মন্দিরের ক্ষিরের প্রসাদ অসাধারণ। সেখান থেকে আমরা চলে গেলাম ইমামি জগন্নাথ মন্দিরে। মন্দিরটি খুব বেশি দিন তৈরি হয়নি। এই মন্দিরটি পুরীর মন্দিরের আদলে গড়া ,অনেকটা জায়গা জুড়ে ।অসাধারণ ভাস্কর্য্ম রয়েছে চারপাশে। সুন্দর পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা।সাজানো বাগান,খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এখানে ভালো খিচুড়ি ভোগ পাওয়া যায়। আমরা পুজো দিয়ে বেড়িয়ে পরলাম…
এখান থেকে আমরা রওনা দিলাম দেবকুন্ডের উদ্দেশ্যে। ওখান থেকে দেবকুণ্ড যেতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা গাড়িতে। কিন্তু তার আগে সকালের খাবার তো খেতে হবে। কিন্তু এযে গ্রামের পর গ্রাম।কোনো দোকানপাট নেই। অনেক দূরে গিয়ে একটা গঞ্জ মতো দেখা গেল। সেখানে কয়েকটি দোকান রয়েছে। সেখানে একটা দোকানে কচুড়ি ঘুগনি ও রসগোল্লা খেয়ে নিলাম সবাই। আমার ছেলে কোথাকার এক সারমেয়কে আপেল খাওয়াবে বলে চেস্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু সারমেয়টি আপেল খাওয়াতে বিশেষ অনিহা প্রকাশ করে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি অগত্যা এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে তার বিরসবদনে আনন্দ সঞ্চারের চেষ্টা করলাম। তারপর আবার যাত্রা শুরু…
দেবকুন্ডতে যাওয়ার সময় আমরা মোবাইল-এ location on করে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার সময় প্রকৃতির সুন্দর রুপ উপভোগ করলাম দু-চোখ ভরে… কত গ্রাম…কত মাঠ ঘাট… কত জংগল পেরিয়ে কত রকমের গাছ, পাখি, ফুল, ফল…আহা!! সার্থক এ-মানব জনম। অবশেষে এভাবেই পৌঁছে গেলাম দেবকুন্ড। সেখানে একটা জায়গার পর আর গাড়ি যেতে দিচ্ছিল না। অনেকটা হাঁটাপথ । লাল মাটির রাস্তা ধরে অনেকটা পথ পেরতে হবে। আমরা প্রথমে বেশ আনন্দের সাথে হাঁটা শুরু করলাম।কিন্তু কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে যেন আর পা চলছিল না।একটা পাহাড়ি সেতু পেরিয়েই সবাই বলল পৌঁছে গেছি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপর বুঝলাম যে আমরা কতটা ভুল ছিলাম। সামনে পরে রয়েছে ৩০০ টা খাড়াই সিঁড়ি! মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তখন আমার অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি! মা ও আমার ছেলেকে দেখলাম আনন্দে লাফাতে লাফাতে ওপরে উঠতে লাগল। আমিও কিঞ্চিত সাহস পেয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম। ওপরে একটা ঝর্ণা রয়েছে। সেখানে গিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়া গেল। জায়গাটা খুব সুন্দর। অনেক বড় ঝর্ণা নীলরঙ-এর জল…কাচের মতো পরিস্কার! চারিদিকে উঁচু পাহাড়। উপর থেকে ঝর্ণার জল পড়ছে। উপরে তাকিয়ে আবছা দেখলাম, সেই ঝর্ণার একপাশেই একটা মন্দির। এটি অম্বিকা মায়ের মন্দির। ঝর্ণার বাষ্প যেন পুরো পাহারটাকেই সাদা করে ফেলেছে। আবার উপরে উঠতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটা জায়গা থেকে সিঁড়ি নিচে নামতে শুরু করল।সেখানেই পাহাড়ের খাঁজে রয়েছে এই মন্দির। ভেতরটা অন্ধকার…কালো মুর্তি… শুধুমাত্র একটা প্রদীপ জ্বলছে।কি যেন একটা ভাবছিলাম। হঠাৎ চমকে উঠলাম ঘণ্টা ধ্বনিতে। বলতে লজ্জ্বা নেই, কিছুটা ভয়-ই পেয়েছিলাম। অদ্ভুত এক অনুভুতি নিয়ে নেমে এলাম। ফেরার সময় দেখলাম অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমরা গাড়িতে ফিরে গেলাম। ফেরার পথে উদালাতে দুপুরের খাবার খাওয়া সারলাম। ফেরার পথে কত পাহাড় সারির মধ্যে দিয়ে ফিরছিলাম। হাত ছোঁয়ালেই যে নীলাগিরি! তখন সন্ধ্যে হয় হয়। প্রথমেই গেলাম রাজবাড়িতে। সেখানে ঢোকার মুখেই বড়ো সিংহ দরজা। ঢুকেই ডানদিকে বড়ো দুর্গা দালান ,বাঁ পাশে মন্দির। রাজবাড়ির ভগ্নদশা, এই অবস্থা সারানোর কাজ হচ্ছিল। রাজবাড়ির লাগোয়া রাস্তা ঢালু হয়ে উঠে গেছে পাহাড়ে (নীলাগিরি)। ঢালু রাস্তা নেমে গেছে যেদিকে, সেখানে রয়েছে জগ্ননাথদেবের মন্দির। এই রাজার-ই তৈরি। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে রাতে ফিরে এলাম চাঁদিপুর হোটেলে। আরও একটি রাতের অবসান হল।
পরের দিন সকাল ৭ টায় সব লাগেজ গুছিয়ে আমরা হোটেল ছাড়লাম। গন্তব্য পঞ্চলিংগেশ্বর। পঞ্চলিংগেশ্বর যেতে সময় লাগল প্রায় ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট। খুব ভালো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মনোরম পরিবেশ। ওখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও খুবই ভালো। গাড়ি পার্ক করেই আমরা খাবারের খোঁজ করতে লাগলাম ও সকালের প্রাতরাশ সারা হলো ।এখানে হাঁটাপথটাই অনেকটা খাড়াই।…অনেকটা রাস্তা। তবে রাস্তার দু-ধারে অনেক রকমারি দোকান পসরা সাজিয়ে বসে আছে। হেঁটে যেতে খারাপ লাগলো না। আমরা পুজোর ডালি নিলাম।মা পুজো দেবে। এ-দোকান, ও-দোকান ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন প্রবেশ দ্বারের কাছে পৌঁছে গেলাম। এবার শুরু হলো সেই সিঁড়ি। দেবকুন্ডতে ছিল ৩০০টি সিঁড়ি।আর এখানে ৩১০টি সিঁড়ি মাত্র! জয় বাবা বলে উঠতে শুরু করলাম কোনো দিকে না তাকিয়ে। এখানে একটা সুবিধে হলো, সিঁড়ির পাশে রেলিং আছে ধরার জন্য। অনেক বার থেমে থেমে উঠলাম। অবশেষে পৌঁছলাম সেই স্থানে। সেখান থেকে নিচের দিকে সিঁড়ি নেমে গেছে। সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিচে মন্দিরে পুজো দেবে বলে। ছোট একটা ঝর্ণাধারা নেমে গেছে নিচে। সেখানে একটা ছোটপাহাড়ি খাঁজ বা গুহা মতো আছে। সেখানে আছে পঞ্চলিংগেশ্বরের পাঁচটি শিবলিঙ্গ।কিন্তু শিবলিঙ্গের ওপর থেকে ঝর্ণার জল পড়ছে বলে শিবলিঙ্গ দৃশ্যমান নয়। সবাই সেই ঝর্ণার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে শিবলিঙ্গ স্পর্শ করছে; তারপর সেই ভেজা কাপড়েই মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরে আসছে। আমরাও পুজো দিলাম।শুধু আমি ভিজে যাওয়ার ভয়ে, ঝর্ণার জল স্পর্শ করেই পালিয়ে এসেছি।আর বেশি কিছু চেষ্টা করিনি। মা খুব আনন্দিত দুটো শিবলিঙ্গ স্পর্শ করতে পেরেছে বলে। কি adventure! এরপর ফেরার পালা…।
এদিকে ফেরার পথে চাঁদিপুরে সমুদ্র দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ মা কিছুতে ভুলতেই পারছিল না। তাই আমরা ঠিক করলাম দুপুরটা আমরা দীঘাতেই কাটাব। চলে গেলাম সোজা দীঘা। এখনকার দীঘা অনেক উন্নত হয়েছে। আগের মতো নেই আর। বাবা মা-কে দেখলাম অবাক হয়ে শুধু দেখেই যাচ্ছিল। হয়তো এই নতুন দীঘা তাদের অচেনা, হয়তো বা তাদের পুরনো কোনো সুখস্মৃতি মনে পড়ছিল। তবে সমুদ্র দেখে যে তাঁদের খুব ভালো লেগেছে তা বোঝাই যাচ্ছিল। সমুদ্রে স্নান করে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, ঘোড়া চেপে, সে কি আনন্দ! আমার ছেলের আনন্দ ছিল দেখার মতো ।সে জল ছেড়ে কিছুতেই উঠবে না। আর আমরা দু-জন (আমি আর আমার তিনি) সমুদ্রের পাড় ধরে হেটে “আর ওওও দূরে” চলে গেলাম। ফেরার সময় কেন জানিনা, খুব মন খারাপ হয়ে গেল। দীঘাকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রহনা হলাম। গাড়িতে তখন গান বাজছে হাল্কা সুরে ‘সাগওওওর ডাকেএএএএএএ… আয় আয় আয়…’।আমার বুকের ভেতরেও।কারণ সমুদ্র শুধু মায়ের নয়, আমারও যে খুব প্রিয়…।
পুনশ্চ: মজার কথা , বাড়ি ফিরে আমার ছেলে কিন্তু পরের দিন ও ভোর ৫ টায় উঠে পড়েছিল। অভ্যাস ভুলতে পারছে না।
ছবি: দিব্যেন্দু ধোলে