Home / রবিবারের আড্ডা / ভ্রমন / উড়িষ্যা ভ্রমণ করতে চার দিনের ছুটিতে বেরিয়ে পড়লাম

উড়িষ্যা ভ্রমণ করতে চার দিনের ছুটিতে বেরিয়ে পড়লাম

উড়িষ্যা ভ্রমণ

শর্মিষ্ঠা দত্ত

জানুয়ারিতে টানা চারদিনের ছুটি তাই বেশ কয়েক মাস আগেই প্ল্যান করা হয়েছিল এই ট্যুরের। রাতে হাওড়া থেকে করমন্ডল এক্সপ্রেস ধরে সকাল এগারোটা নাগাদ উড়িষ্যার বালুগাঁও স্টেশনে নেমে অটোতে রম্ভা ও টিডিসির পান্থনিবাসে পৌঁছলাম সদলবলেl দলবল বলতে আমরা দুজন ছাড়াও আমার হাজব্যান্ডের আরো চারজন কলেজের বন্ধু ও তাদের স্ত্রী। উদ্দেশ্য অল্পস্বল্প ঘোরা আর বহুদিন পরে নির্ভেজাল আড্ডা।

আমাদের দলনেতা শ্রীরঞ্জনদা ট্রেনেই ঘোষণা করেছিলেন বেশিক্ষণ বিশ্রামের সময় দেওয়া হবে না। ঝটপট করে যে যার রুমে গিয়ে স্নান সেরেই বেরিয়ে পড়লাম চিল্কা দেখব বলে। লাঞ্চের অর্ডার দেওয়া থাকল, ফিরে এসে খাবো। রুমের ব্যালকনি থেকে একঝলক দেখেই অবশ্য ছটফট করছিলাম কতক্ষণে চিল্কার কাছে যাব।
উড়িষ্যা
পান্থনিবাসের পিছনদিকের গেট থেকে টানা সোজা একটা বাঁধানো রাস্তা জলের ওপর দিয়ে চলে গেছে জেটি অবধি, দু-ধারে রেলিং দেওয়া। তার শেষ মাথায় ডান দিকে সিঁড়ি নেমে গেছে জেটির দিকে, সেখানে সার সার জেলে নৌকো দাঁড়িয়ে। ওরাই আবার পর্যটকদের জলবিহারে নিয়ে যায়। সোজা এগোলে রাস্তার শেষ মাথায় একটা অর্ধগোলাকার রেলিং দেওয়া চাতাল। সেখানে দাঁড়ালেই চিল্কার অনন্ত জলরাশি চোখের সামনে উন্মুক্ত। মাঝে মাঝে জাল দিয়ে ঘেরা মাছের ভেড়ি আর খুব ছোট ছোট কিছু দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। সামনে তাকিয়ে দেখি চাতালের ওপরে বেশ সুন্দর সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গা রয়েছে, তার মাথায় সুন্দর শেড… সেখানে ক্যামেরা ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে ফটোগ্রাফার ও তার সহকারীরা রেডি। অল্পবয়সী দুটি ছেলেমেয়ে তাদের নির্দেশে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে ফটোশ্যুট করতে ব্যস্ত। প্রথমে ভেবেছিলাম কোনো ওড়িয়া সিনেমার শ্যুটিং বুঝি, পরে বুঝলাম প্রি-ওয়েডিং শ্যুট!
উড়িষ্যার পথে ,আমরা
লাঞ্চের পর সদলবলে বেরোলাম নৌকাবিহারে। বিকেল হয়ে এসেছে, তাই বেশিদূর যাওয়া গেল না। তরুণ তপন তখন আচ্ছন্ন প্রৌঢ়ত্বের ধূসরিমায়। আকাশের অস্তরাগে জলপাখিদের ইতস্তত ওড়াউড়ি, মাছরাঙা আর শামুকখোলের আহারপর্ব দেখতে না দেখতেই অবাক!
‘চুপ চুপ! ওই ডুব দেয় পানকৌটি
দেয় ডুব টুপ টুপ ঘোমটার বৌটি!’
সত্যেন দত্ত আওড়াতে আওড়াতে দেখলাম জলের শঙ্খচিলের ডানায় শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা নেমে আসছে চিল্কার বুকে। বুদ্ধদেব বসুর থেকে ধার নিয়ে একটা শব্দ বদলে নিয়ে মনে মনে উচ্চারণ করলাম: ‘কি ভালো আমার লাগল আজ এই সন্ধ্যেবেলায় …কেমন করে বলি’!
ভ্রমণ
২.

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই সাতটা বেজে গেল। আসলে কফি আর চিকেন পাকোড়া সহযোগে আড্ডা-কবিতাপাঠ আর গানে বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছিল সান্ধ্য আসর। ফলে রাতের খাওয়া এবং শোয়াতেও বিলম্ব। তাড়াতাড়ি স্নান আর ব্রেকফাস্ট সেরে নটার মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম সকলে। আজ নৌকোয় করে ঘুরব চিল্কার ছোট ছোট দ্বীপে। একটা বড় নৌকোতেই লাইফ জ্যাকেট পরে উঠে পড়লাম আমরা দশজন। এসময় প্রচুর নাম না জানা বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি উড়ে আসে এখানে, যত গভীরে যাচ্ছি ততই বেশি পরিমাণে তারা দৃশ্যমান। কোথাও কোথাও জলের ওপর সারি বেঁধে বসে আছে রূপোলী ফিতের মতো। আমরা গঞ্জাম জেলা থেকে পুরীর দিকে এগিয়ে চলেছি জলপথে। আসলে চিল্কায় দুদিক দিয়েই আসা যায়। এর মধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট ছোট দ্বীপ। সব দ্বীপে যাওয়া সম্ভব হবে না আমাদের। ফিরতে হবে লাঞ্চের আগেই তাই মাত্র দু-তিনটিতেই যাওয়া হবে, এই সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছিল।
প্রথমেই গেলাম একেবারে সামনে ব্রেকফাস্ট আইল্যান্ডে। পান্থনিবাস থেকেই এই দ্বীপটা দেখা যায়। দ্বীপ বলতে একটা বেঁটে লাইট হাউস আর দুদিক খোলা একটা ছোট্ট ঘর। ব্যস… ঘরটা দেখলেই ছোটবেলায় অরণ্যদেব কমিকসের কিলা-উইর সোনাবেলার সেই ঘরটার কথা মনে পড়ে। ঠিক তেমনই যেন বেশ মজার। এরপর একে একে হানিমুন আইল্যান্ড, ডাইনোসর আইল্যান্ড ঘুরে পরে আরো কিছুটা ঘুরলাম। নৌকো থেকে আর নামলাম না। জানুয়ারি মাসেই বেশ কষ্ট হচ্ছিল রোদের তাপে অতঃপর প্রত্যাবর্তন পান্থনিবাসে।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর একটা স্করপিও গাড়ি করে চললাম মন্দির দর্শনে। উড়িষ্যা মন্দিরের দেশ। এর আগে যতবার এসেছি প্রতিবারই ঘুরে বেড়িয়েছি বিভিন্ন মন্দির প্রাঙ্গণে। তবু মনে হয় স্থাপত্যশৈলী এবং ঐতিহাসিক মূল্যায়নে প্রতিটি মন্দিরই অনন্য। প্রথমে গেলাম কালিকোটে গ্রামের কাছে নারায়ণী মন্দিরে। দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী নারায়ণী বা লক্ষ্মী।
উড়িষ্যা ভ্রমন
এরপর গেলাম কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি বিখ্যাত নির্মলঝর মন্দিরে। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা বালুকেশ্বর মদ্ররাজ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। পূর্বঘাট পর্বতমালার গায়ে অবস্থিত মন্দির চত্বরে ঢুকতেই দুদিকে দুটি প্রাকৃতিক জলকুণ্ড রয়েছে। এগুলি প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্ট। সম্ভবত নির্মল ঝর্ণা থেকেই মন্দিরের এই নামকরণ। প্রধান অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলা ছাড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিষ্ণু ,সূর্য ও দশাবতারের মন্দিরও। বেশ খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে একেবারে ওপরে একটা টং ঘর রয়েছে তার ভিতরে একটা বড় ঘণ্টা। ওখান থেকে চারপাশের অনেকটা দৃশ্য দেখা যায়। সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল ,পরের দিন আবার গোপালপুর যাত্রা, তাই মন্দির দর্শনে ইতি টানতে হল।

৩.

তিরিশ বছর পরে গোপালপুরে এলাম। অনেকটা পরিবর্তন চোখে পড়ল আর সেটাই স্বাভাবিকl ভিড় অনেক বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হোটেলের সংখ্যাl

প্রথম দিন স্বল্প সমুদ্রস্নান আর সী-বিচের ধারের দোকানপাট দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। প্ল্যান অনুসারে পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর যাত্রা করলাম তারাতারিণী মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
বেরহামপুর থেকে বত্রিশ কিলোমিটার দূরত্বে উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলায় ঋষিকুল্যা নদীর ধারে কুমারী পাহাড়ের ওপর এই মন্দিরটির পৌরাণিক অস্তিত্ব থাকলেও এটি মধ্যযুগে, সম্ভবত সপ্তদশ শতকে কলিঙ্গ সম্রাট বসুপ্রহরাজ দ্বারা নির্মিত এবং পুরাণে কথিত একান্নটি সতীপিঠের অন্যতম। পৌরাণিক তথ্য অনুসারে দক্ষযজ্ঞের পর শিবের তাণ্ডবনৃত্যের সময় সতীর বুকের পাঁজর এসে পড়েছিল এখানে; এটি একটি বিখ্যাত তন্ত্রসাধনার কেন্দ্রও বটে।
কুমারি পাহাড়
কুমারী পাহাড়ের ওপরে যাওয়ার সহজ ব্যবস্থা হলো রোপওয়ে। টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ালাম; চারদিক ঢাকা কেবিনে চারজনের বসার ব্যবস্থা। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অসাধারন দৃশ্য; নিচে ঋষিকুল্যা নদী দেখা যায়। অনেকটা হরিদ্বারের চণ্ডীমাতা মন্দিরের রাস্তার মত। অনেক ছবি তুললাম তখনইl মন্দির চত্বরে যে-কোনো পাহাড়ি মন্দিরের মতই হনুমানের উপদ্রব। বাইরের দোকান থেকে পুজোর ডালা কিনে, ওখানেই জুতো খুলে ভেতরে ঢুকলাম। পাথরের তৈরি তারা ও তারিণীদেবীর জোড়া মন্দির। উত্কল স্থাপত্যে তৈরি। গায়ে খোদাই করা অজস্র মূর্তি। ভিতরে সোনা-রূপোর অলংকারে সাজানো দেবীমূর্তি গুলিতেও দাক্ষিণাত্যের প্রভাব। খুব বেশি ভিড় ছিল না, তাই পুজো দিতে বেশিক্ষণ লাগল না। মন্দির চত্বরে এসে দাঁড়াতেই হাত থেকে প্রসাদের ডালা ছিনতাই! কতক্ষণ ধরে যে তিনি আমার পুজো শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিলেন কে জানে! হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়েই একলাফে মন্দিরের বাউন্ডারী ওয়ালে। তবে আমার সামনেই আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে প্রসাদের লাড্ডু ভক্ষণের মধ্যে বেশ একটা মাচো ব্যাপার আছে এটা বলতেই হবে!
আবার রোপওয়ে পার হয়ে পাহাড়ের নিচে এসে গাড়িতে উঠলাম। দুপুরে গোপালপুর পান্থনিবাসে লাঞ্চ। চোখে এবং ক্যামেরায় বন্দী হয়ে রইল অনবদ্য কিছু দৃশ্য ও ভাললাগার মুহূর্তগুলো।

৪.

পূর্বঘাট পাহাড়ের ওপর গজপতি জেলায় তপ্তপাণি একটা অসামান্য সুন্দর জায়গা। এখানে একটা উষ্ণ-প্রস্রবণ রয়েছে তাই জায়গাটার নামও তপ্তপাণি। বছর তিরিশেক আগে বিয়ের পর এখানে এসেছিলাম মধুচন্দ্রিমা যাপনে। এখানকার পান্থনিবাসের অতিথি হয়ে কাটিয়েছিলাম তিনদিন। এবারে অবশ্য রাত্রিবাস নয়, অল্প সময়ের জন্যই আসা। তবুও কিছুক্ষণের জন্য কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিলাম বৈকি! মূল বাড়িটির দুটি স্যুটের লাগোয়া স্নানঘরের বিশাল বাথটবে হটস্প্রিং এর জল ভরে দেওয়া হতো। সেই স্নানের স্মৃতি আজও অম্লান। পাহাড়ের গায়ে ইতস্তত ছড়ানো কটেজগুলোর দ্বিতীয়টিতে আমরা ছিলাম। তিরিশ বছর বাদেও সেগুলি মোটামুটি অপরিবর্তিত রয়েছে। শুধু ওপরের টালির রঙ লাল থেকে সবুজ হয়েছে এটাও পরিবর্তন!
উড়িষ্যা ভ্রমণ
দুপুরে এখানে খাওয়া দাওয়া করে চন্দ্রগিরির তিব্বতী মন্দির পদ্মসম্ভবা মহাবিহারে এলাম। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকেই তৈরি হয়েছে মঠটি। অন্যান্য বৌদ্ধ মন্দির গুলোর মতোই শান্ত -ভাবগম্ভীর পরিবেশ। বিশাল হলঘরে প্রচুর ছাত্র প্রার্থনা করছে অথচ কোনো শোরগোল নেই। কিছুক্ষণ থেকে আবার ফেরার পালা। ফেরার পথে বেরহামপুর বাজারে শপিং সেরে ফিরে এলাম গোপালপুর।
ছুটি শেষ। এই কদিনের সুন্দর স্মৃতি নিয়ে পরেরদিন আবার বেরহামপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে ফিরে যাব যে যার গন্তব্যে, নিজের নিজের বৃত্তে।
আরও পড়ুন: রাজস্থান ভ্রমণ : জয়সালমীর থেকে কুলধারা একটি ভৌতিক নগরী

Check Also

রাজস্থানের ভৌতিক গ্রাম

রাজস্থানের রহস্যময় কিরারু গ্রাম

দেবশ্রী চক্রবর্তী: ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত একখন্ড মরুপ্রান্তরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে রহস্য এবং রোমাঞ্চ। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *